রাজ্যের বেসরকারি ডিএলএড কলেজগুলিতে (D EL ED Colleges) অনলাইনে ভর্তি (Online Admission) হওয়াই নিয়ম। কিন্তু তা ভেঙে হাজার হাজার পড়ুয়াকে ঘুরপথে টাকার বিনিময়ে অফলাইনে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। এ জন্য ছাত্রপিছু অন্তত ৫ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছিল বলে জেলবন্দি মানিক ভট্টাচার্যের (Manik Bhattacharya) বিরুদ্ধে অভিযোগ ইডির (ED)। এখন এই পড়ুয়াদের ভবিষ্যত কী হবে, তা নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ মার্চ মাসে তাদের একটি ব্যাচের পরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ আপাতত অফলাইনে ভর্তি হওয়া এই পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশন দিতে নারাজ। দু’বছর পড়াশোনা করে পরীক্ষায় বসার আগে এই পড়ুয়ারা জানতে পারছেন, তাঁদের ভর্তিটাই অবৈধ হয়ে যেতে পারে। যার জেরে ২০২১-২০২৩ ব্যাচে রাজ্যের বেসরকারি ডিএলএড কলেজে ভর্তি হওয়া ৪০-৪২ হাজার পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছেন এঁরা। অনেকে ইতিমধ্যে টেটে (TET) সফলও হয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁরা ডিএলএড ডিগ্রিটা পাবেন কি না, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে সংশয়। অথচ এনসিটিই-র নিয়মে প্রাথমিকে শিক্ষকতার (Primary Teachers) জন্য এই ডিগ্রি আবশ্যিক।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পাল রবিবার জানান, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সব পড়ুয়াকেই রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল। কিন্তু তা চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। গত ৫ জানুয়ারি পর্ষদের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। তাই, অফলাইনে ভর্তি হওয়া এই পড়ুয়াদের অ্যাডমিশন বৈধ না অবৈধ, সেটা এখন বিচারাধীন বিষয়। অনলাইনে ভর্তি হওয়াদের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও সংশয় নেই। গৌতমের বক্তব্য, ‘অফলাইনে ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের জন্য তো যাঁরা অনলাইনে, বৈধ পথে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের পরীক্ষা আটকে রাখা যায় না। আমরা অফলাইনে ভর্তি হওয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও বিষয়টি এখন বিচারাধীন।’ পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ও প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মামলায় ইডির অন্যতম হাতিয়ার, বেসরকারি ডিএলএড কলেজে এই অফলাইন ভর্তির প্রক্রিয়া। পার্থর বিরুদ্ধেও অফলাইনে আসন বিক্রি করে ছাত্রভর্তি ও বিনিময়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনেছে ইডি। এ ব্যাপারে মানিক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডলের জবানবন্দিকেও হাতিয়ার করেছে তদন্তকারী সংস্থা।
পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে বর্তমানে ৬৫৬টি ডিএলএড কলেজ রয়েছে। যার মধ্যে ৬৫টি সরকারি। কাজেই বেসরকারি কলেজের সংখ্যা অনেক বেশি। আর সমস্যাটা এই সব কলেজেই। এত কলেজের মধ্যে ২০২১-এ ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের মধ্যে মাত্র ১১ হাজার ছাত্রছাত্রী অনলাইনে ভর্তি হন। তাঁরা মার্চে ডিএলএড পার্ট ওয়ানের পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ পেয়েছেন। বাকি প্রায় ৪২ হাজার ছাত্রছাত্রী। এঁদের অভিযোগ, ২০২১-এর পরের ব্যাচ যুক্ত করলে সঙ্কটে থাকা পড়ুয়ার সংখ্যা লক্ষাধিক হবে। গৌতমের বক্তব্য, ‘বিচারাধীন বিষয়ে বেশি মন্তব্য করব না। তবে অফলাইনে কত ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।’
তাহলে এই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার কী হবে? পর্ষদ তাকিয়ে আদালতের দিকে। আর চরম উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন এই পড়ুয়ারা। এঁদের অনেকে ২০২২-এর টেটে সফলও হয়েছেন। কিন্তু ডিএলএড ডিগ্রি না পেলে তো চাকরি মিলবে না। অনেকের মধ্যে এমনই দু’জন, বীরভূমের বছর চব্বিশের আবির চক্রবর্তী ও উত্তর ২৪ পরগনার বছর ছাব্বিশের শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। আবির জানান, তিনি ২০২১-এ সিউড়ির একটি বেসরকারি ডিএলএড কলেজে অফলাইনে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের ছেলেটির বাবা প্রায় শয্যাশায়ী। মা আশাকর্মী। সরকারি চাকরির আশায় এক আত্মীয়ের থেকে এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা ধার করে ডিএলএডে ভর্তি হয়েছিলেন। জুলজিতে স্নাতক এই তরুণের ধাপে ধাপে আরও ৩০ হাজার টাকা ফি মেটানোর কথা কলেজকে। এখন পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন অধরা।
ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সন্তান মোস্তাফিজুরও টেটে সফল হয়েছেন। ৬০ হাজার টাকা ফি দিয়ে ভর্তি হন ডিএলএড প্রশিক্ষণ কলেজে। পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনিও। বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল, অফলাইনে ভর্তি হওয়াটাও নিয়ম। এখন শুনছি, এটা নাকি দুর্নীতি! কিন্তু ভর্তির সময়ে এ কথা কেউ আমাদের বলেনি। দু’বছর ধরে ক্লাস করলাম, প্র্যাক্টিক্যাল, প্রজেক্ট করলাম। ইন্টারনাল পরীক্ষা দিলাম। এখন বোর্ডের পরীক্ষার আগে বলা হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে না।’ সমস্যা সমাধানের দাবিতে জোট বেঁধেছেন ভুক্তভোগীরা। সল্টলেকে পর্ষদের অফিসে ডেপুটেশন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ জমায়েতের অনুমতি দেয়নি বলে অভিযোগ।