অবশেষে দলের ‘পুরোনো সোনা’দের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন শুভেন্দু অধিকারী। লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে দিলীপ ঘোষ একতরফা ব্যাট চালাতে শুরু করেছেন। সরাসরি কারও নাম উল্লেখ না করলেও তাঁর নিশানা যে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দিকে, তা স্পষ্ট।দিলীপের নেতৃত্বে বঙ্গ-বিজেপির একাংশ যে নির্বাচনে খারাপ ফলের জন্য তাঁকেই কাঠগড়ায় তুলতে চাইছে সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি শুভেন্দুরও। এ প্রসঙ্গে এতদিন কোনও উচ্চবাচ্য না করলেও শেষ পর্যন্ত শনিবার দিলীপ-ব্রিগেডের আক্রমণের কড়া জবাব শুভেন্দু দিয়েছেন সরাসরি কারও নাম উল্লেখ না করেই।
ভোটে হারার পর থেকেই দিলীপ বোঝাতে চাইছেন, ২০১৯-এ তিনি রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন বঙ্গ-বিজেপির সংগঠন যে জায়গায় ছিল তার ছিটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। সে কারণেই বাংলা থেকে বিজেপির আসনসংখ্যা ১৮ থেকে কমে ১২ হয়ে গিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতির জন্য নাম না করে শুভেন্দু এবং রাজ্য বিজেপির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকেই দিলীপ দায়ী করছেন।
শনিবারও তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, তাঁর মতো পুরোনোরাই দলের আসল সম্পদ। নিজের এক্স-হ্যান্ডেলে এদিন তিনি লেখেন, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড।’ এর পাল্টা হিসেবে শনিবার পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দুও কারও নাম না করে বলেন, ‘যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম পোস্ট করছেন, বড় জ্ঞান দিচ্ছেন, তাঁরা মনে হয় অতীত জানেন না। ২০০৪ সালে তৃণমূলের আসন নয় থেকে কমে এক হয়ে গিয়েছিল। তার থেকে তো বিজেপি অনেক ভালো অবস্থায় আছে।’
রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০১৯ লোকসভা ভোটের সঙ্গে এ বারের ফলাফলের তুলনা টেনে দিলীপ শিবির কৌশলে শুভেন্দুর নেতৃত্বকে খাটো করে দেখাতে চাইছে। এদিন ঘুরিয়ে তার জবাব দিতে গিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘২০১৯-এর থেকে অনেক বেটার জায়গায় আমরা আছি। তখন আইপ্যাক ছিল না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও ছিল না। সংখ্যালঘুদের সিএএ, এনআরসির নামে ভয় দেখানোও ছিল না। পুলিশের এরকম সন্ত্রাসও ছিল না। এতকিছুর পরেও ২০২১-এর নিরিখে আমাদের এক শতাংশ ভোট বেড়েছে।’
২০১৯-এ লোকসভা ভোটের পর থেকেই বঙ্গ-বিজেপিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নতুন-পুরোনো সংঘাত। অন্য দল থেকে আসা নেতাদের ভিড় যত বাড়তে থাকে, ততই স্নায়ুচাপ বাড়তে থাকে পদ্মের পুরোনো নেতাদের উপর। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পরে দিলীপ জমানা অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গ-বিজেপিতে ‘নতুন’দের দাপট বাড়তে থাকে বলে দলের একাংশের অভিযোগ।
আর সেই ‘নতুন শিবির’-এর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও কোনও রাখঢাক না করে বুঝিয়ে দেন, শুভেন্দুই তাঁদের ‘ব্ল্যাক হর্স’। কিন্তু এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে বিজেপির আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজ্য বিজেপিতে সমীকরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। দিলীপ ঘোষ সরাসরি জেহাদ ঘোষণা করে দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির ক্ষমতাসীন শিবিরের বিরুদ্ধে। তবে নাম না করে তাঁর লক্ষ্য মূলত শুভেন্দুই।
এদিন সেই লড়াইয়ে পুরোনো সঙ্গীদের পাশে পেতে দিলীপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ লেখেন। পাশে থাকার বার্তাও মিলতে শুরু করে সঙ্গে সঙ্গে। দিলীপের ডানহাত হিসেবে পরিচিত রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এটা শুধু দিলীপ ঘোষের কথা নয়, এটাই চিরন্তন সত্য। এটা বাজপেয়ীজি থেকে নাড্ডাজিরও সবার কথা। আমি আগেই বলেছিলাম, দল পুরোনো কর্মীদের না নামালে নির্বাচনে ভালো ফল হবে না।’
দিলীপ জমানায় রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি ছিলেন রাজকমল পাঠক। তিনি এদিন বলেন, ‘দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা এসে পাঁচতারা হোটেলে ওঠেন। সেখানেই স্তাবকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারপর দিল্লি ফিরে গিয়ে অমিত শাহদের রিপোর্ট দেন। ফলে বাংলার প্রকৃত ছবিটা শীর্ষ নেতৃত্বর কাছে পৌঁছয় না।’
এমনকী, শীর্ষ তৃণমূল নেতা তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও এদিন বিজেপির অন্দরের যুদ্ধে দিলীপকেই নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দিলীপ ঘোষ ঠিকই বলেছেন। ওল্ড ইজ গোল্ড। যে কোনও রাজনৈতিক দলেই নবীন-প্রবীণ ভারসাম্যের মধ্যেই থাকে সাফল্যের চাবিকাঠি। আমাদের দলে এই ফর্মূলাতেই সাফল্য এসেছে।’ তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বেও ফিরহাদ প্রবীণদের পক্ষে ছিলেন।