এ হলো তিন মেধাবী মেয়ের কাহিনি। দুর্গাপুরের সগড়ভাঙার ডেয়ারিমোড়ের সোমা কর্মকার, রুমা কর্মকার ও লক্ষ্মী কর্মকারের কথা মনে আছে? পরিচারিকার কাজ করে ২০১৬-র উচ্চ মাধ্যমিকে ৭০ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলেন তিন বোন। ‘এই সময়’ পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হলে তিন বোনকে ডাকা হয় কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে। সেখানে আর্থিক সাহায্য ছাড়াও বড় বোন সোমার কানে জটিল অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। তার পরই তিন বোনের সামনে খুলে যায় উচ্চশিক্ষার রাস্তা। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিন বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখায়। ২০১৬-২০২২, এই ৭ বছর পড়াশোনা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই চালিয়েছেন তাঁরা। এখন বড় বোন সোমা একটি নামী বহুজাতিক ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থায় চাকরি করছেন। বি-টেক পড়ার পাশাপাশি একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন লক্ষ্মী। রুমা একটি নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। এখন বিয়ের পর টিউশন পড়ান।
ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিলেন তিন বোন। মা প্রতিমা কর্মকার পরিচারিকার কাজ করতেন। মাটির দেওয়াল টালির ছাদের নীচে খুপরি ঘর। সেখানেই তিন মেয়েকে নিয়ে ছিল প্রতিমার সংসার। তিন মেয়ের বয়সের ফারাক থাকলেও আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় তিন জনকেই এক শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছিলেন প্রতিমা, যাতে এক সেট বইতেই পড়তে পারে সবাই। অর্থকষ্ট জয় করে তিন বোনের উচ্চ মাধ্যমিক পাশের খবর প্রকাশিত হলে তাঁদের ডাক পড়ে কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দপ্তরে। সেখানে তিন বোনকেই অর্থ সাহায্য করা হয়। সোমা কানের জটিল রোগে ভুগছিলেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর ও প্রশাসন। দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের হৃদশল্য চিকিৎসক সত্যজিৎ বসুর সঙ্গে কথা বলে মুখমন্ত্রীর দপ্তর। অস্ত্রোপচারে প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার টাকা। হাসপাতাল ৪০ হাজার টাকা ছাড় দেয়। বাকি ৩০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দেন তৎকালীন মহকুমাশাসক শঙ্খ সাঁতরা। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে সেই টাকার সংস্থান করে দুর্গাপুর কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় এক দম্পতিও।
প্রথমে সোমা ভর্তি হন দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজে। স্নাতক স্তরে পড়ার পাশাপাশি দুর্গাপুর আইটিআইতে ইলেট্রিক্যাল বিভাগে পড়ার সুযোগ পান সোমা। আইটিআই পাশ করে তিনি দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে এক বছর কাজ করেন। এর পরেই নামী ইঞ্জিনিয়ারিং ও পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্থায় চাকরি পেয়ে যান তিনি। প্রশিক্ষণের পর এখন ওডিশার বারবিলে ওই সংস্থায় টেকনিশিয়ান পদে কাজ করছেন সোমা। খনির কাজে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন যন্ত্র, গাড়ি, ডাম্পার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যুক্ত তিনি। কাজ করতে হয় দু’টি শিফ্টে।
অন্য দিকে, দুর্গাপুরের রাজেন্দ্রনাথ অ্যাকেডেমি লক্ষ্মী আর রুমার পড়ার দায়িত্ব নেয়। সেখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন লক্ষ্মী। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের রানিগঞ্জ শাখায় কর্মরত। পাশাপাশি কাঁকসার মলানদিঘির একটি বেসরকারি কলেজে তিনি বি-টেক করছেন। রবিবার তিন কন্যার কথা শুনে রাজেন্দ্রনাথ অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘খুব ভালো খবর। ওরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এমন অনেক ছাত্র-ছাত্রীই আমাদের কলেজ থেকে পাশ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
চলতি মাসেই মা প্রতিমা কর্মকারকে হারিয়েছেন সোমারা। তাঁদের জীবনে চলার পথে মায়ের ভূমিকা ভুলতে পারেন না। সোমা বলেন, ‘আজ মা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন। মা না থাকলে আমরা তিন বোন তো ভেসে যেতাম। চলার প্রতি মুহূর্তে মাকে স্মরণ করি।’ সাত বছর আগের সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সোমা বলেন, ‘সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাহায্য না করলে হয়তো এত দূর আসতেও পারতাম না। মুখ্যমন্ত্রী সাহায্য করার পর অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রত্যেকের সহযোগিতায় আজ আমাদের পায়ের তলার মাটিটা একটু শক্ত হয়েছে।’