Justice Abhijit Ganguly: আহা! প্রতীক গেলে খাবোটা কী! – justice abhijeet ganguly comments on trinamool congress party and symbol stir controversy here is the brief analysis of bengal political situation


প্রশান্ত ভট্টাচার্য

বেশি কথার বেশি দোষ,
ভেবেচিন্তে কথা কোস।

মাঝে মাঝেই এই প্রবচনটি স্মরণ করিয়ে দিতেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। সতর্কতাটা সবার ক্ষেত্রেই খাটে। মুদ্দাই থেকে মুনসেফ, সবার জন্যই সত্য। আমি জজ হয়েছি বলে, জিভের ডগায় যা এল, তাই উগরে দেব। ডান-বাঁ ভাবব না। আরও একটা প্রবচন মনে পড়ছে, সভায় কথা বললেই ধরা পড়ে কে মূর্খ কে পণ্ডিত। আমার আজকাল মনে হয়, কথা বললেই বেরিয়ে পড়ে ছপ্পরে থাকা রাজনৈতিক অবস্থানটা। আমারও বেরোয়, তোমারও বেরোয়। রামারাও বেরোয়,শ্যামার বেরোয়। বচনের কী লীলা। কুচোচিংড়ি থেকে রাঘববোয়াল, সবাই কেতরে যায় মুখ ফসকে। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে সমালোচনা বা কিসসা।

এত কথা এসে পড়ল, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আমাদের রাজ্যে যে কেলেঙ্কারি চলছে, তার একটা ধরতাই করতে গিয়ে। আমাদের আদালত ও বিচারপতিদের সৌজন্যে রাজ্যবাসী জানতে পারলেন, কত উপযুক্ত প্রার্থী আজও চাকরি না পেয়ে পথে বসে আছেন। আর প্রতিদিনই দেখছি একটা না একটা মামলা হচ্ছে, আসছে স্থগিতাদেশ। এখন দেখছি বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা-ই নয়, জজে ছুঁলে আঠেরো’শ ঘা। পার্থ-কেষ্ট দশা। তবু বলব, আদালত আমার কাছে সুরলোক নয়, জজেরাও নয় ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। আমি এখনও বিশ্বাস করি, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে কোনও প্রতিষ্ঠানই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। সবটাই চলে রাষ্ট্র নামক অমানবিক সংস্থার অঙ্গুলি হেলনে। সেখানে দু’-একজন ব্যক্তি মানুষ এতটাই ব্যতিক্রমী হন যে আমাদের সাধারণ আশা মরতে মরতে মরে না।

Calcutta High Court : লাল-নীলবাতির যথেচ্ছ ব্যবহার কেন? রাজ্যের জবাবদিহি তলব হাইকোর্টের

কিন্তু এটা না বললে সত্যের অপলাপ হবে যে এই ব্যতিক্রমী মানুষগুলোও মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। পর্যবেক্ষণের নামে এমন কথা বলে ফেলেন, যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। যেমন এই মুহূর্তে এক রাজনীতিক আরেক জজকে বলছেন, ‘অরণ্যদেব’। অথচ এমনটা হওয়া তো কাঙ্খিত নয়। যে যাঁর প্রেমিসেসে ঠিকঠাক থাকলে তো এমনটা হয় না। যদিও বিচক্ষণ আইনজীবী ও সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Kalyan Banerjee) ফুটনোট, ‘একজন বিচারপতির মৌখিক কথার কোনও মান্যতা নেই। কোনও বিচারপতি যদি লিখিতভাবে এরকম কথা বলার ‘সাহস’ দেখান তারপরে কী করতে হয় দেখা যাবে। কোনও বিচারপতি মামলার ভিতরে যা নেই, সেই কথা বলতে পারেন না।’ আসলে আদালতের পর্যবেক্ষণের মোড়কে সংবাদমাধ্যমে খবর হওয়ার প্রবণতা, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার মানসিকতা। ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি করা। কিন্তু বিচারবিভাগের পক্ষে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। তার মর্যাদাকে হালকা করার নামন্তর।

SSC Scam: অযোগ্যদের নিয়োগে বাড়তি আসন মামলায় ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ সুপ্রিম কোর্টের

নিয়োগ দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী (Sujan Chakraborty) প্রমুখ যে বিচারপতির রায়ে, আদেশে ভরসা পাচ্ছেন তাঁর মুখে ‘প্রতীক কেড়ে নিতে বলব?’ মন্তব্যে একটু হোঁচট খেয়েছেন। সুজন তো বলেই ফেললেন, ‘বিচারপতির মত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও সংবিধানসম্মত মনোভাবের বাইরে কারওরই যাওয়া উচিত বলে মনে করি না।’ অধীর চৌধুরীর হালও তথৈবচ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকেও বলতে হল, ‘ওই বিচারপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছেন, অনেক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। রাজনৈতিক দল আন্দোলন, প্রতিবাদের বাইরে কতটা আর করতে পারে? সেখানে বিচার বিভাগের ক্ষমতা যে ভাবে কাজে লাগছে, আমরা তাকে সমর্থন জানিয়েছি। কিন্তু কোনও দলের স্বীকৃতি বা প্রতীক সংক্রান্ত মন্তব্য বেসুরো ঠেকেছে। মনে হয়েছে, এটা মূল বিষয়ের বাইরে চলে গিয়ে একটা বেপথু মন্তব্য।’

Justice Abhijit Gangopadhyay : ‘বাংলার গর্ব’, বাইকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান ব্যবসায়ী

হক কথা কয়েছেন অধীর। বেপথু। যেমন মুখ্যমন্ত্রীর কথায় কথায় স্থগিতাদেশ নিয়ে পালটা বিচারপতির ‘এগরোল’ উদাহরণও বড্ড ছেঁদো কথা হয়ে গিয়েছে। এই স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত আমার ৪০ বছর আগের একটা কথা মনে পড়ছে। ১৯৮২ সালের ৬ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বামফ্রন্ট সরকার অনুরোধ জানায় যে, এপ্রিল মাসে রাজ্যে বর্ষা এসে পড়ার আগেই ১৫ মার্চ বিধাসসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। ২১ জুন পর্যন্ত ছিল সরকারের মেয়াদ। কংগ্রেস চাইছিল, মেয়াদ টপকে দিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু হোক, আর তখন ভোট হোক। সেই ধান্ধায় কংগ্রেস কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ আদায় করেছিল। যতদূর মনে পড়ে সেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়। সেই মামলা যখন সুপ্রিম কোর্টে গড়াল তখন আজেকের প্রধান বিচারপতির বাবা ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় (V Y Cahndrachur) ছিলেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন। সেই সময় সুপ্রিম কোর্টে অশোক সেনের মতো বর্ষীয়ান আইনজীবী কংগ্রেসের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন যে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী তথা আইনজীবী কংগ্রেস নেতা অশোক সেন ও চারজনকে শীর্ষ আদালতে অ্যাপোলজি চাইতে হয়। কৌতুহলী পাঠক পাতা উলটে দেখে নেবেন সেদিন দেশের প্রধান বিচারপতির কলকাতা হাইকোর্টের প্রতি পর্যবেক্ষণটাও খুব সম্মানের ছিল না। যাই হোক সেদিন শীর্ষ আদালতের সৌজন্যে শেষ পর্যন্ত মে মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

DA Update : DA নিয়ে যুদ্ধ অন্তিম পর্যায়ে! বকেয়া পাবেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা?

তবে প্রতীক কাড়তে বলবেন, দলটাকে তুলে দিতে বলবেন এগুলো কোনও কাজের কথা না, রাগের কথা। আমরা তো জানতাম, জজ সাহেবরা খুব গেম্ভারি লোক হন। কম কথা বলেন। হাকিম নড়ে তবু হুকুম নড়ে না। তা’হলে রাজনৈতিক দলের চটুল মুখপাত্রদের মতো কথা কেন? এতে তো পদ ও পদী, দুয়েরই অসম্মান হয়। তবে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে আজ বিচারপতি যে ধরনের পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছেন তা নবিশদের কাছে নতুন হলেও ভারতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের নিশ্চয়ই ইউপিএ সরকারের কথা মনে পড়ছে। সেই জমানায় টুজি স্ক্যাম নিয়ে শুনানির সময়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এক সময়ে প্রায় ধারাবাহিকভাবে এমন পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছিলেন যে তাতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছিল মনমোহন সরকারকে। আর ঠিক সে সময়ে কংগ্রেস নেতারা নিয়ম করে সাংবাদিক বৈঠক করে আদালতের এ হেন পর্যবেক্ষণ নিয়ে পালটা আক্রমণ শানাতেন। পালটা মত জানাত কংগ্রেস। আসলে সরকার দুর্বল হয়ে পড়লেই বিচারবিভাগ কখনও কখনও অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। এ ঘটনা বার বার ঘটেছে। এখন বঙ্গে তাই চলছে। তবে দু’দিন ধরে তো অনেকের কথাই শুনলাম, দেখলাম চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর কথার ভার আছে। রাজ্যের এই মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এ ধরনের কথা আগে কখনও বিচারপতিদের মুখে শুনিনি। নির্বাচন কমিশনকে উনি বললেই তৃণমূলের প্রতীক বাতিল হয়ে যাবে এমন নয়। দেশে আইন রয়েছে।’ তারপরই বিধিবদ্ধ সতর্কতা জারির মতো চন্দ্রিমা বলেছেন, ‘আইনের মধ্যে দিয়ে আমরা চলিনি এটা যদি কারও প্রশ্ন হয়, তা হলে জেনে রাখা ভাল যে আইনের মধ্যে দিয়ে দেশের প্রতিটি নাগরিকেও চলতে হয়। তার মধ্যে বিচারপতিরাও পড়েন।’ আর ঠিক এখানে আমার মনে পড়ছে, বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেশের নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে একটি মন্তব্য নিয়ে মামলায় দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় (সেই সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন) স্মরণ করিয়েছিলেন, ‘একজন বিচারপতিকেও শৃঙ্খলা মানতে হয়।’

Supreme Court: একই দিনে বিজ্ঞপ্তি ও ক্লিয়ারেন্স কীভাবে? নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের

আইন, বিচার সম্পর্কে নিরক্ষর আমার একটা কথা, জজ সাহেবদেরও তো ভুল হয়, নইলে সিঙ্গল বেঞ্চের রায় ডবল বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায় কেন? কেন মহকুমা আদালতের রায় জেলা আদালতে খারিজ হয়ে যায় কিংবা হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্টে? জজবাবুরা নিশ্চই আইন কম জানেন না! তবে? আসলে জজবাবুও একজন মানুষ। বাড়িতে ছেলেটার শরীর খারাপ বা মা কিংবা স্ত্রীকে দুটো কুকথা শুনিয়ে এসে কাজের দায়ে ধরাচূড়া পরে এজলাসে বসলেও মনটা বিক্ষিপ্ত থাকে, কাজে মনোযোগ থাকে না, কথা বলার সময় কন্ট্রোল থাকে না। হতেই পারে। হবেই বা না কেন! জজ বলে কি শালগ্রাম শিলার মতো নিষ্প্রাণ হতে হবে!?

(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *