সব্যসাচী বাগচী
আর্জেন্টিনা: ২ (‘৪৬ ম্যাক অ্যালিস্টার, ‘৬৭ জুলিয়ায় আলভারেজ)
পোল্যান্ড: ০
অ্যাটাক, অ্যাটাক এবং শুধুই অ্যাটাক। এই মন্ত্র মেনে মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা (Argentina)। পোলিশদের ডিফেন্স ভাঙতে শুরু থেকেই নীল-সাদা বাহিনী তুলেছিল ঝড়। কিন্তু ফাইনাল থার্ডে গিয়ে আটকে যাচ্ছিলেন লিওনেল মেসি (Lionel Messi)-অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ারা (Angel Di Maria)। আচ্ছা ইউরোপের দলগুলো কি এভাবেই লাতিন আমেরিকার দলগুলোকে শুরুতে বেগ দিচ্ছে! এই যেমন ব্রাজিলের (Brazil) কথা ধরুন। আর্জেন্টিনার চিরপ্রতিদ্বন্দী সেলেকাওরাও তাদের খেলা দুই ম্যাচে গোল পেতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছিল। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গোল পেতে ব্রাজিলকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৬২ মিনিট পর্যন্ত। সুইৎজারল্যান্ডর বিরুদ্ধে গোল এসেছিল ৮৩ মিনিটে। তবুও তো এসেছিল। প্রথমার্ধে অনেক নাটকের পর গোল পেল ৪৬ মিনিটে। অ্যালেক্স ম্যাক অ্যালিস্টার (Alexis Mac Allister) পা থেকে এল গোল। ৬৭ মিনিটে দ্বিতীয় গোল করে পোলিশদের কফিনে আরও পোক্ত করে পেরেকটা পুঁতে দিলেন জুলিয়ায় আলভারেজ (Julian Alvarez)। ফলে তিন ম্যাচে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ-সি’র মগডালে থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল লিওনেল স্কালোনির (Lionel Scaloni) দল।
রবার্ট লেভানডফস্কি (Robert Lewandowski) ও আরকাদিয়শু মিলিকের দুই স্ট্রাইকার থাকলেও, শুরু থেকেই পোলিশরা আলট্রা ডিফেন্সিভ মেজাজে চলে গিয়েছিল। আর তারপর চালু হল ডিফেন্স করার ‘খেলা’। পোলিশদের ডিফেন্সে সবচেয়ে বেশি উচ্চতার ফুটবলার বার্তোশ বেরেশিনস্কি। তাঁর উচ্চতাও ৬ ফুট। সে ক্ষেত্রে সেট পিস , কর্নার থেকে উড়ে আসা বলগুলো কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডদের। গড় উচ্চতাতেও পিছিয়ে ছিল স্কালোনির দল। তাঁর দলের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি । অন্যদিকে পোল্যান্ডের গড় উচ্চতা ৬ ফুটের চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু ‘ফুটবল দেবতা’ মেসিদের অপেক্ষা করালেও, তাঁদের দিকেই মুখ তুলে তাকালেন।
দীর্ঘকায় ডিফেন্ডারদের যোগ হলেন গোলকিপার ওয়েশনিখ স্ট্যাশনের (Wojciech Szczesny)। স্ট্যাশনেরই ১৮ বছর বয়সে আর্সেনালে খেলার সময় কেরিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছিল। জিমে স্কোয়াট করার সময়ে তিনি ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেন। ভারী ওজন তাঁর হাতে পড়ে গিয়েছিল। দুই হাতই ভেঙে যায় ওই ঘটনায়। ফুটবল খেলা তো দূরের কথা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারেননি চার মাস। এহেন সদাহাস্য গোলকিপার প্রথমার্ধে অন্তত সাত-আট সেভ দিলেন। তবে একটা সময় তাঁকেও মাথানত করতে হল। আর্জেন্টাইদের স্কিলের কাছে।
৩৬ মিনিটে ফের একবার গোল করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেই রানিং বল ক্লিয়ার করার সময় দ্বিতীয় পোস্টের কিছুটা বাইরে ছিলেন মেসি। স্ট্যাশনের বাঁ হাত মেসির মুখে লাগে। ‘ভার’ দেখে পেনাল্টি দেন বিতর্কিত রেফারি ড্যানি মেকেলিয়ে। সেই সময় স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর নীল-সাদার গ্যালারির মেজাজ ছিল দেখার মতো। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল মেজাজ। কারণ আর্জেন্টাইনদের ‘ভগবান’ পেনাল্টি মিস করলেন! অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে মেসির শট বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচিয়ে দিলেন স্ট্যাশন। ঠিক যেমন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মহম্মদ বুরায়কের রিবাউন্ড শটও রুখে দিয়েছেন তিনি ০.২৪ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে। সেই গোলকিপার জোড়া গোল হজম করবে কেন জানত!
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই এ যেন অন্য আর্জেন্টিনা! দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল করে দিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার। ডাউন দ্য লাইন দৌড়েছিলেন মোলিনা। সেখান থেকে তিনি ক্রস করেছিলেন। স্ট্যাশন এতটুকু জায়গা না দিয়ে সেই রানিং বল জালে জড়িয়ে দিলেন তিনি। এগিয়ে গেল নীল-সাদা বাহিনী। এই গোলটার জন্য শুধু গোটা দুনিয়ার আলবেসেলেস্তেরা অপেক্ষা করে বসে ছিলেন না। অপেক্ষায় ছিলেন মেসিও। কারণ ওই পেনাল্টি মিস করার পর যদি দলটা হেরে যেত, তাহলে নিজেকে আজীবন ক্ষমা করতে পারতেন না। সবাই ভুলে যেত মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জয়ের নেপথ্যে তাঁর অবদানের কথা। ৬৭ মিনিটে এবার বিপক্ষের বক্সে হানা দিলেন তরুণ জুলিয়ান আলভারেজ। মাঝমাঠ থেকে এনজ়ো ফের্নান্দেসের পাস পেয়েছিলেন। খুলে গেল ‘লক গেট’। ডান পাসে নিখুঁত শটে বল জালে জড়ালেন তিনি। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা।
স্বর্গীয় এই বাঁ পায়ে আরও একবার উদ্ধার পেলে মেসির ভালো লাগত। আর্জান্টাইনদের আনন্দ হত। কতবার তিনি দেশকে উদ্ধার করেছেন, সেটা মেসিও স্বয়ং মনে করতে পারবেন না। বাঁ পা নিয়ে এমন কাব্যও কত পড়েছেন, তা মনে করাও তো কঠিন কথা। সেই বাঁ পা কখনও দিয়েগো মারাদোনার। কখনও আবার মেসির। ওঁর কেরিয়ারের শুরু থেকেই বিখ্যাত পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। মেসি নামে সেই রত্নের মূল্য আর্জেন্টাইনরাই অনেক দিন বুঝতে চাননি। মেসির অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দেশের মানুষের মন জয় করাও তাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ক্লাবের জার্সিতে কেন ভালো খেলেন, আর্জেন্টিনার জার্সিতে কেন নয়—এই প্রশ্নে কান ঝালাপালা হয়েছে তাঁর। আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত মুখস্থ আছে কি নেই, এমন আলোচনাও হয়েছে। এবারের বিশ্বকাপে জাতীয় সংগীত চলার সময় মেসির দিকে একটা ক্যামেরা তাক করা থাকত। সেখানে স্পষ্ট ধরা পড়েছে, অন্য সতীর্থদের কাঁধে হাত রেখে তিনিও গলা ছেড়ে দেশের গান গাইছেন। তাই এই বিশ্বকাপ যত এগোচ্ছে, তত মনে হচ্ছে, আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে স্থান পেতে মেসির আকুতির আর দরকার নেই। আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে তাঁর অক্ষয় আসন পাতা হয়ে গিয়েছে।
অতীতেএ বিশ্বকাপগুলোতে আর্জেন্টিনার ম্যাচে সমর্থকদের হাতের পতাকা-ব্যানারে মেসিও থাকতেন, তবে মারদোনা এগিয়ে থাকতেন বিপুল ব্যবধানে। এবার আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা রীতিমতো মেসিময়, প্রয়াত মারাদোনা শুধু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য দুজনের ছবি পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছেন। শুধু এভাবেই না থেকে আক্ষরিক অর্থে তাঁর ফুটবল ‘আইডল’-এর পাশে স্থান পেতে কী করতে হবে, মেসির সেটা অজানা নয়।
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি মারাদোনা দেশের জার্সিতে বিশ্বকাপে মোট ২১টি ম্যাচে খেলেছিলেন। এদিন ৯৭৪ স্টেডিয়ামে নেমে মেসি ছাপিয়ে গেলেন ‘ফুটবল রাজপুত্র’-কে। বিশ্বকাপে এই ম্যাচের পর মোট ২২টি ম্যাচে খেলার রেকর্ড গড়লেন ‘এল এম টেন’। দেশের জার্সিতে মেসির নামের পাশে আজকের ম্যাচের আগে পর্যন্ত রয়েছে ১৬৭টি ম্যাচে ৯৩ গোল। সেটা এই ম্যাচে আর বাড়ল না। তবে চেষ্টার খামতি রাখেননি। তাঁর বাঁ পা অনবরত গোলের খোঁজে ছিল। এর মানে বুঝলেন তো? বিশ্বকাপের জন্য আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের হাহাকার ঘোচানোর বাহন একটাই। স্বর্গীয় এই বাঁ পা! খেলা তো সবে শুরু। এখনও অনেক খেল বাকি। স্বর্গীয় এই বাঁ পা-র ম্যাজিক আরও দেখা যাবে।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)