সব্যসাচী বাগচী
আর্জেন্টিনা: ২ (‘৩৫ লিওনেল মেসি, ‘৫৭ জুলিয়ান আলভারেজ)
অস্ট্রেলিয়া: ১ (‘৭৭ এনজো ফার্নান্ডেজ, আত্মঘাতী গোল)
এটাই ফুটবলের মজা। এই জন্য ফুটবল এত সুন্দর খেলা। পরতে পরতে থাকে উত্তেজনা। একটু পা হড়কে গেলেই ব্যস খাদে চলে যাওয়া। চলতি বিশ্বকাপে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসে বারবার সেটা মনে হচ্ছিল। ৭৬ মিনিট পর্যন্ত মাঠজুড়ে আর্জেন্টিনার দাপট। লিওনেল মেসির পর জুলিয়ান আলভারেজের গোলের সৌজন্যে ২-০ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঠিক এমন সময় ৭৭ মিনিটে খেলায় নতুন টুইস্ট এনে দিলেন ক্রেগ গুডউইন। কিন্তু রানিং বল এনজো ফার্নান্ডেজের মাথায় লেগে গোলে ঢুকে যায়। ব্যবধান কমিয়ে আনে অজিরা। সেই গোল পাওয়ার পর অজিরা সমতা ফেরানোর তাগিদ দেখালেও লাভ হয়নি। কারণ বারবার জোড়া গ্লাভস হাতে রুখে দাঁড়ালেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ফলে ২-১ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে কাপ জয়ের আরও একধাপ এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা।
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একটা ‘অভিশাপ’ ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কাঁধ থেকে গেল নক আউটে গোল করতে না পারার ‘অভিশাপ’। তাও আবার পেশাদার কেরিয়ারের ১০০০তম ম্যাচে। আহমদ বিন আলী স্টেডিয়ামে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হারের পর থেকে লিওনেল মেসির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একেবারে বদলে গিয়েছে। এই মেসি শুধু মন দিয়ে ৯০ মিনিটের যুদ্ধে নিজের স্কিল দেখান না। সতীর্থদের চাঙ্গা করার দায়িত্বও পালন করেন। এবং দরকার হলে বিপক্ষের কাছে মার পর্যন্ত খেতে তিনি রাজি। সময় সময় আবার ফোঁস করেও উঠেছেন অধিনায়ক। এহেন মেসিকে আগে দেখা যায়নি। এই মেসি আগের থেকে অনেক বেশি ফোকাসড। বারবার ওঁকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। হাবভাব ঠিক যেন সীমান্তে পাহাড়া দেওয়া এক জওয়ানের মতো। যিনি যুদ্ধে নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিতে রাজি। এবং দরকার হলে বিপক্ষের প্রাণ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না। কারণ নিজের শেষ কাপ যুদ্ধের অভিযানে অধরা বিশ্বকাপটা হাতে তুলে নেওয়াই তাঁর একমাত্র ‘মিশন’।
পারফর্মাররা নিজের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বড় মঞ্চকে বেছে নেন। মেসি তেমন দ্বিতীয় রাউন্ডের এই ম্যাচকেই বেছে নিয়েছিলেন। শুধু তো গোল করলেন না। টপকে গেলেন তাঁর ফুটবল ‘আইডল’ দিয়েগো মারাদোনাকে। আর্জেন্টাইনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার কীর্তিও মেসির ঝুলিতে। ২১ ম্যাচ নিয়ে এর আগে শীর্ষে ছিলেন মারাদোনা। চলতি বিশ্বকাপে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে গোল করার পর মারাদোনাকে আগেই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। এবার অজিদের বিরুদ্ধে গোল করে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ককে ছাপিয়ে গেলেন তিনি। কাপ যুদ্ধে আর্জেন্টিনার হয়ে নয় গোল ‘এল এম টেন’-এর ঝুলিতে। তার আগে একমাত্র রয়েছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। তাঁর গোলসংখ্যা ১০।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া না থাকার জন্য এদিন শুরু থেকে আর্জেন্টিনার আক্রমণ ঠিক জমছিল না। উইং প্লে জমে উঠছিল না। এরসঙ্গে যোগ হয়েছিল অজিদের গায়ে-গতরে পাওয়ার ফুটবল। এই ম্যাচটা খেলতে নামার আগে অজিদের বিরুদ্ধে পাঁচটা হলুদ কার্ড ছিল। তবে সেই হিসেবের পরোয়া না করে মেসি থেকে শুরু করে এমিলিয়ানো মার্তিনেস, মার্কোস আকুনাদের অহেতুক ফাউল করতে শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছক বদলে নেয় নীল-সাদা ব্রিগেড। মাঝমাঠে ছোট ছোট পাস খেলতেই খুলে যায় গোলের মুখ।
৩৫ মিনিটে চলে এল সেই ‘গোল্ডেন মোমেন্ট’। বিশ্বকাপের নকআউটে প্রথম গোল করলেন মেসি। কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে আর্জেন্টিনার ফুটবলারকে ফাউল করায় ফ্রিকিক পায় আর্জেন্টিনা। ফ্রিকিক থেকে সরাসরি গোল না হলেও ফিরতি বল পান মেসি। দি পলের সঙ্গে দেওয়া নেওয়া করে বক্সে ঢুকে বাঁ পায়ের মাটি ঘেঁষা শটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন মেসি।
ব্যস, সেই গোল হজম করার পর অজি কোচ গ্রাহাম আর্নল্ডের দলের সব জারিজুরি শেষ হয়ে গেল। যে কোচ এই ম্যাচের আগে থেকে আর্জেন্টিনাকে দেখে ও বুঝে নেওয়ার কথা শুনিয়ে আসছিলেন, গোল হজম করার পর পুরো ব্যাপারটা যেন বদ হজম হয়ে গেল অজিদের কাছে। অন্যদিকে গোল পেয়ে যাওয়ার পর রক্ষণ মজবুত করতে তৎপর হয়ে যান মেসিদের হেড কোচ লিওনেল স্কালোনি। চোটের কারণে পাপু গোমেজকে তুলে লিসেনাদ্রো মার্টিনেজকে মাঠে নামিয়ে দেন।
এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর থেকেই খেই হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেটা ৫৭ মিনিটে বোঝা গেল। এবার গোল করলেন জুলিয়ান আলভারেস। দলের অধিনায়ক ও গোলকিপার ম্যাট রায়ান বক্সের মধ্যে বেশিক্ষণ হোল্ড করার খেসারত দিলেন ম্যাট রায়ান। তাঁর পা থেকে বল ছিনিয়ে নেন আলভারেস। বলকে ফাঁকা গোলে ঢুকিয়ে আর্জেন্টিনাকে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে দেন এই তরুণ।
মনে হচ্ছিল এই স্কোরলাইন রেখেই আর্জেন্টিনা মাঠ ছাড়বে। ঠিক সেই সময় মেসিদের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিলেন গুডউইন। ৭৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট মারেন গুডউইন। বক্সের মধ্যে এনজো ফার্নান্ডেজের মাথায় লেগে বলের দিক বদলে যায়। কিছু করার ছিল না গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেসের। আত্মঘাতী গোল দেওয়া হয় এনজো ফার্নান্ডেজের নামে। স্কোরলাইন দাঁড়ায় ২-১।
গত বৃহস্পতিবার রাতে স্পেনের বিরুদ্ধে জাপানের জয় দেখে বিশ্বকাপ নিয়ে কিছু অনুমান করতে ভয়ই লাগছিল। কখন কোন দল কার হাতে ‘খুন’ হবে, বলা কঠিন। ভাবতেই পারিনি, স্পেনের মতো দল জাপানের কাছে হারবে। জাপান এর আগে জার্মানিকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে চারবারের চ্যাম্পিয়নরা আর বেরোতেই পারেনি। সৌদিও একইভাবে আর্জেন্টিনার পথে কাঁটা বিছিয়েছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত ‘জার্মানি’ হয়নি। ছন্দ ফিরে পাওয়া আর্জেন্টিনা আজ শেষ ষোলোতেও স্বাচ্ছন্দ্যে বেরিয়ে গেল। লেখা ভাল অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল।
অস্ট্রেলিয়া এই প্রথম বিশ্বকাপে টানা দুটি জয় পেয়েছে, ঠিক আছে। গ্রাহাম আরনল্ডের ছেলেরা বেশ উজ্জীবিত, সেটাও সত্য। মাঠে ওদের অ্যাথলেটিসিজম ভালো। কিন্তু ওরা বিশ্বকাপে টানা তৃতীয় ম্যাচ জিতে যাবে, এতটা কোনও ফুটবল পন্ডিত ভাবেননি। তাছাড়া টেকনিক্যালি অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে আর্জেন্টিনা ঢের এগিয়ে। সঙ্গে যখন মেসি আছেন। তখন যে অজিরা মানসিক ভাবে পিছিয়ে যাবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল না।
আর্জেন্টিনার ওপরেই বাজি রেখেছিলাম। সেটা এমন নয় যে নামের কারণে। আসলে আর্জেন্টিনা গত ম্যাচে ‘আর্জেন্টিনার’ মতোই খেলেছে। পোল্যান্ডকে যেভাবে চেপে ধরে জয় তুলে নিয়েছে, দুর্দান্ত শব্দটাও কম হয়। নীল-সাদা জার্সিধারীরা সব সংশয় উড়িয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে এসেছে। সেই গতিটা ধরে রাখতে পেরেছে বলেই মেসিদের সামনে অস্ট্রেলিয়া কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ২-১ ব্যবধান দেখে অনেকের মনে হতেই পারে অজিরা দারুণ লড়াই করেছে। তবে সেটা ভাবলে ভুল। শেষ দিকের কয়েকটা মিনিট দপ করে জ্বলে ওঠা, আর পুরো ম্যাচজুড়ে জেতার তাগিদ দেখানোর মধ্যে ফারাক আছে।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)