সব্যসাচী বাগচী
ফুটবল পন্ডিতরা ইতিমধ্যেই আলোচনায় বসে গিয়েছেন। কাতার বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022) থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo) ও তাঁর পর্তুগালের (Portugal) এমন কাঁটার মুকুট নিয়ে বিদায়ের কারণ কি? অনেকের মনে হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার (South Korea) বিরুদ্ধে তাঁকে তুলে নেওয়ার পর থেকে, কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোসের (Fernando Santos) সঙ্গে চলতে থাকা ‘ইগোর লড়াই’-এই ভরাডুবির কারণ। পর্তুগালের এমন করুণ পরিণতি হল। আবার আর এক শ্রেণির দাবি, ‘সি আর সেভেন’ (CR7) কাতারে পা রাখার আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (Manchester United) ও সেই দলের কোচ এরিক টেন হ্যাগের (Eric Ten Hag) সঙ্গে চলা ঝামেলা প্রকাশ্যে না আনলেই পারতেন। তাঁর ক্যাবিনেটে তখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ (FIFA World Cup) অধরা। কে বলতে পারে পিয়ার্স মর্গ্যানকে বিস্ফোরক সাক্ষাতকার না নিয়ে, পর্তুগিজ মহাতারকা নিজের ‘ইগো’ সংযম করলে হয়তো তাঁকে সাজঘরে শরীরকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় কেঁদে ভাসাতে হত না!
কথা ছিল শেষ বিশ্বকাপ তিনি ভরিয়ে দেবেন মহানায়কীয় মেজাজে। মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়াবেন নিজের বুটজোড়ার দমে। কিন্তু সমস্যা তিনি বিতর্কিত। তাঁর মেজাজ বেশিরভাগ সময় সপ্তমে থাকে। যেহেতু তিনি মহাতারকা, তাই বেপরোয়াও। কিন্তু তাঁকেও তো মনে রাখতে হবে ৩৭ আর ২৩ বছর এক নয়। একে তো তাঁকে ঘিরে একনাগাড়ে চলতে থাকা বিতর্ক, আর এরসঙ্গে যোগ হয়েছে পর্তুগিজদের অনন্ত প্রত্যাশা। তাই শেষবার যাওয়ার আগে তিনি রাঙিয়ে দিয়ে যেতে পারলেন না। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির মতো। নিজের হাতে তৈরি করা সোনার সংসার ঘেঁটে দিলেন! ফুটবল দেবতা তো এমন আচরণ সহ্য করবেন না। তা রোনাল্ডো যত বড়ই তাঁর ভক্ত হোন। স্বভাবতই বিশ্বকাপের উজ্জ্বল মঞ্চ থেকে বিষণ্ণ বিদায় হল ক্রিশ্চিয়ানোর।
অথচ তিনিই তো প্রমাণ করেছিলেন, ভাগ্যের দেখিয়ে দেওয়া পথ নয়। বরং ভাগ্যের দেবতা তাঁকেই বরমাল্য দেয়, যিনি পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য তৈরি করে নিতে জানেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো মানেই গোটা বিশ্বের কাছে সেই অদম্য জেদের মন্ত্র। হাল না-ছাড়ার ছড়িয়ে দেওয়া ইস্তেহার। বিপক্ষের প্রাচীর যত দুর্ভেদ্যই হোক না কেন, তাঁর অতিমানবিক স্কিলের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। ম্যাজিক নয়, তিনি জানেন, শক্তির সাধনায় অটুট প্রাচীর ভাঙার মধ্যেই আছে জীবনের সফলতা। কতবার তো সেই শক্তির কাছেই পরাস্ত হয়েছে কত ডিফেন্সের সাজানো ঘর। ফুটবল বিশ্বকে কতবার তিনি দেখিয়েছেন, রেকর্ডের পিছনে নয়, রেকর্ডই তাঁর পিছনে ছোটে। অথচ এহেন মহাতারকাকে তাঁর সম্ভবত শেষ দুটি আন্তর্জাতিকম ম্যাচে ‘সুপার সাব’ হিসেবে মাঠে নামতে হল! ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাস!
২০১৬ সাল। সেদিনও তিনি ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তির ভূমিকায়। ইউরো কাপে দলকে টেনে তুলেছিলেন। কিন্তু মোক্ষম দিনে হানা দিল চোট। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন। আর সেই চোখের জলে লেখা হয়েছিল ফুটবল ইতিহাস। মাঠের বাইরে থেকেও একজন খেলোয়াড় যে খেলতে পারেন, আবেগে-অনুপ্রেরণায় দলের জয়ের পথ তৈরি করে দিতে পারেন, দেখিয়েছিলেন ‘সি আর সেভেন’। ২০২২ অবশ্য অনেকটাই আলাদা। ক্লাব ফুটবলে বিতর্ক। তাবড় কোচ বলছেন, রোনাল্ডো তাঁর সূক্ষ্মতা হারিয়েছেন। তবু তিনি মানতে নারাজ। সমর্থকরাও তো প্রাণভরে তাঁকেই একবার দেখে নিতে চান। তিনি কেন বসে থাকবেন বাইরে! কিন্তু সত্যিই যেন দলকে আর আগের মতো প্রাণবায়ু জোগাতে পারছিলেন না। সামান্য একটা গোল, তাঁর মাথা ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি তা নিয়ে বিতর্ক হল এক সমুদ্র। শেষমেশ জাতীয় দলের কোচও তাঁকে বসিয়ে রাখলেন। আর তিনি তাকিয়ে থাকলেন বিষণ্ন দৃষ্টিতে। এই কি পাওনা ছিল! আক্ষেপ করল গোটা বিশ্ব। আক্ষেপ মিটবে না খোদ ক্রিশ্চিয়ানোর।
লিওনেল মেসি শুরুতে হোঁচট খেলেও, টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দলকে। আর্জেন্টিনা ও লিও যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছেন। বিশ্বকাপটা জিতে প্রয়াত দিয়েগো মারাদোনার আসনে বসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে ঠিক এর উলটো ছবি বরাদ্দ রইল ক্রিশ্চিয়ানোর জন্য। দেশের জন্য, ফুটবলের জন্য তিনিও কম কিছু করেননি। মহানায়কের গৌরব নিয়েই এ যাত্রা শেষ হওয়ার কথা ছিল তাঁর। তবু জীবন যেমন মাধুর্যময় তেমন নিষ্ঠুরও। মহানায়কের মতো নয়। বরং একরাশ বিতর্ক, কোচের আস্থা হারানো এবং মাথায় কাঁটার মুকুট পরে বিদায়ের পথে হাঁটা দিলেন পর্তুগিজ মহাতারকা।