মদ্রিচদের বিরুদ্ধে চার বছর আগের বদলা নিয়ে ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনা, এবার দিয়েগোকে ছোঁয়ার অপেক্ষা


সব্যসাচী বাগচী 

আর্জেন্টিনা: ৩ (‘৩৪ পেনাল্টি লিওনেল মেসি, ‘৩৯, ‘ ৬৯ জুলিয়ান আলভারেজ) 

ক্রোয়েশিয়া: ০

০-৩ ব্যবধানে বদলা নিল আর্জেন্টিনা। সেই এক ৩-০ ব্যবধানে। ২০১৮ সালের ২১ জুন রাশিয়া বিশ্বকাপে এই ক্রোয়েশিয়ার কাছে লজ্জার হার হজম করেছিল আর্জেন্টিনা। এবার সেই ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে দিল আলবেসেলেস্তেরা। তফাত শুধু সেটা গ্রুপ পর্বের ম্যাচ ছিল। আর এটা চলতি কাতার বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল। এমন একটা ম্যাচে লুকা মদ্রিচের দলকে লিওনেল মেসির নীল-সাদা বাহিনী মারল যে এখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। তাই নিয়ম মেনে গতবারের রানার্সদের উড়িয়ে ফাইনালে চলে গেল আর্জেন্টিনা। এবার শুধু দিয়েগো মারাদোনাকে ছোঁয়ার অপেক্ষা। ৩৬ বছর ধরে একটা ক্ষত আর্জেন্টাইনরা বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। সেই জ্বালা মেটানোর জন্য ১৮ ডিসেম্বর ফের একবার লুসেল স্টেডিয়াম ও এই স্টেডিয়ামের নীল-সাদা রঙে রাঙিয়ে ওঠা গ্যালারি তৈরি হয়ে থাকবে। মেসি কি তাঁর ‘আইডল’ দিয়েগো মারাদোনা হতে পারবেন? আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। 

ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, মেক্সিকোতে ‘ভগবানের যে হাত’ দিয়ে দিয়েগো মারাদোনা গোল দিয়েছিলেন পিটার শিল্টনকে পরাস্ত করে, সেই হাতটাই তিনি তাঁর যোগ্য চ্যালা মেসির মাথায় রেখেছেন! পরপর কয়েকটা ক্লান্তিকর ম্যাচের ধকল লুকা মদ্রিচদের মতো বয়স্ক ফুটবলাররা কতটা নিতে পারেন সেটা দেখার বিষয় ছিল। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে পুরো ১২০ মিনিট খেলার পর, টাইব্রেকারে ফল এসেছিল। এমন ম্যাচ খেললে শরীরের সঙ্গে মনের মারাত্মক ক্ষরণ হয়। একটা দলের পক্ষে রিহ্যাব করা কঠিন। বিশেষ করে, বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরের খেলায়। সেটাই দেখা দিল ৩০ মিনিটের পর থেকে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চার বছর আগের প্রতিশোধ নিল আলবেসেলেস্তেরা। তাও আবার ৩-০ গোলে হারিয়ে। 

আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের শেষ চারে গিয়েছে, অথচ ফাইনালে যায়নি, এমনটা অতীতে হয়নি। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। সেই প্রথম ম্যাচে এই লুসেলেই সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এগিয়ে থেকেও হেরেছিল আলবেসেলেস্তেরা। মুখ বুঝে মাঠ ছেড়েছিলেন মেসি। এবারেই তো পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস করেছিলেন। তবে এবার আর বিপক্ষকে সুযোগ দিলেন না। তাই মনে হচ্ছে সত্যিই প্রয়াত মারাদোনার ছায়া এই দলটার সঙ্গে আছে। এমনিতেই লাতিন আমেরিকার ফুটবলে তুকতাকের মারাত্মক প্রভাব। সত্যিই হয়তো মেসিরা হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন, তাঁদের সবার প্রিয় দিয়েগো তাঁদের সঙ্গে আছেন। আর এই ভাবনা যদি দলটার মনোবল বাড়ায়, তা হলে কারও কি কিছু বলার থাকতে পারে? 

শুরুটা একটু ধীরে করলেও ৩০ মিনিটের পর ম্যাচে ফিরে এল আর্জেন্টিনা। যে ডমিনিক লিভাকোভিচ চলতি প্রতিযোগিতায় বারবার দলকে বাঁচিয়েছেন, জাপান ও ব্রাজিলকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া ক্রোয়েট গোলকিপার এত বড় ভুল করবেন নিজেও ভাবতে পারেননি। বক্সের মধ্যে বল দখলের জন্য এগিয়ে এসে এনজো ফার্নান্দেজকে ফাউল করলেন। ডেকে আনলেন নিজের ও তাঁর দলের বড় বিপদ। ওটা ‘মেসি জোন’। সেখান থেকে এক-আধবার তাঁর বাঁ পা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। বারবার নয়। সেমি ফাইনালের মতো মঞ্চে তো কখনই নয়। লুসেল স্টেডিয়ামের গ্যালারি এই মুহূর্তের জন্যই তো অপেক্ষা করছিল। সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত এল ৩৪ মিনিটে। পেনাল্টি থেকে গোল করলেন। দেখতে দেখতে কাপ যুদ্ধের মঞ্চে ১১টা গোল হয়ে গেল। চলতি কাপ যুদ্ধে হয়ে গেল তাঁর পঞ্চম গোল। অগণিত আর্জেন্টাইনদের এই গোল উপহার দিলেন নীল-সাদা বাহিনীর নেতা। একইসঙ্গে ছুঁলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে।

সেই শট নেওয়ার আগে দারুণ কয়েকটা মুহূর্ত চোখের সামনে ভেসে উঠল। মেসি বলটা নিজের পায়ের কাছে বসিয়ে একবার খোলা আকাশের দিকে তাকালেন। নিজের ফুটবল ‘আইডল’ দিয়েগোকে স্মরণ করলেন কিনা সেটা তিনিই বলতে পারবেন। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল আর্জেন্টাইন অধিনায়ক মুখে কিছু বিড়বড় করে বলেই যাচ্ছেন। ক্যামেরা এবার মেসিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে চলে গত ম্যাচের নায়ক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দিকে। মেসির পায়ে বল থাকলেও, তাঁর দিকে তাকালেন না তারকা গোলকিপার। উল্টোদিকের গ্যালারিতে রেখেছিলেন দুই চোখ। বলটা জালে ঢুকতেই পৈশাচিক হুঙ্কার দিলেন মেসির সতীর্থ। 

মেসি তাঁর গোলার মতো শটে নেট কাঁপিয়ে দিতেই মাইক হাতে ধারাভাষ্যকার বলে উঠলেন, ‘কমপক্ষে ১৩০ কিলোমিটার গতিবেগে মেসি পা চালিয়েছেন! তাই তো নেট এমন কেঁপে গেল!’ তখন কে জানত গতবারের রানার্সদের কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য আরও বড় ঝড় অপেক্ষা করছে। ফের একবার ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণ ও লিভাকোভিচ কেঁপে গেলেন। জুলিয়ান আলভারেজের স্কিলের কাছে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিমায় গোল করে গেলেন জুলিয়ান আলভারেস। প্রতি আক্রমণ থেকে নিজেদের অর্ধে বল ধরে প্রায় ৫০ গজ দৌড়ে যান ২২ বছরের এই স্ট্রাইকার। বক্সের বাইরে তিন ডিফেন্ডারকে চমক দিয়ে বক্সে ঢোকেন। লিভাকোভিচকে পরাস্ত করে বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। 

আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যাচের দ্বিতীয় গোলও করলেন আলভারেস। তবে গোলটি যত না তাঁর, তার থেকে অনেক বেশি মেসির। ডান প্রান্তে সাইড লাইনের কাছে বল ধরে ডিফেন্ডারকে ঘাড়ের কাছে নিয়ে এগিয়ে যান মেসি। ডান দিক-বাঁ দিকে ড্রিবল করে বক্সে ঢোকেন। তার পরে বল রাখেন ফাঁকা দাঁড়িয়ে থাকা আলভারেসের কাছে। ডান পায়ে গোল করে ব্যবধান বাড়ান আলভারেস। ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকে ক্রোয়েশিয়ার কামব্যাক করার আশা শেষ করে দেয় মেসির দল। 

এবারের আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ‘ইউএসপি’ হল, দলটার কেন্দ্রবিন্দুতে মেসি থাকলেও, লিওনেল স্কালোনির দল কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর নয়। তবুও সবাই সেই মেসির বাঁ পায়ের দিকেই তাকিয়ে থাকবে। কারণটা অবশ্য স্বাভাবিক। তাঁর সমসাময়িক অন্য দুই ফুটবলার…নেইমার ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো চোখের জলে বিদায় নিয়েছেন। বয়স এখনও নেইমারের সঙ্গে আছে । ইচ্ছে করলে তিনি পরের বিশ্বকাপ খেলতেই পারেন। রোনাল্ডো সাফ জানিয়েছেন, অবসর নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাঁর আপাতত নেই। পাঁচ কোটি টাকার ফিটনেস সরঞ্জাম তাঁকে যতদিন তরতাজা রাখবে, ততদিন নিশ্চিত খেলবেন। মেসি অবশ্য কাতারে পা রাখার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু প্রশ্ন হল এই ম্যাচ জেতার পর যদি ১৮ ডিসেম্বর কাঙ্খিত ও বহু প্রতীক্ষিত সোনার কাপ যদি তিনি হাতে তুলতে পারেন, তাহলে কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন? 

এবার মেসির শারীরিক ভাষা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বাড়তি কিছু করে দেখানোর তাগিদ নিয়ে এসেছেন। আগে জাতীয় সংগীততে ঠোঁট নাড়াতেন না। এবার প্রতি ম্যাচের আগে গলা ছেড়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন। দরকারে বিপক্ষের উপর মেজাজ গরম করেছেন। ঠিক যেমন তাঁর ‘আইডল’ অহরহ করতেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা, মাঠের বাইরে সতীর্থদের আস্থা অর্জনকারী, কর্তৃত্বপরায়ণ এক অধিনায়ক। মাঠের ভিতরও যিনি গোল করে, গোল করিয়ে ম্যাচ জেতাতে পারেন। আবার গোল করুন, কিংবা না করুন সেলিব্রেশন করার জন্য সোজা চলে যান গ্যালারির সামনে। সমর্থকদের সঙ্গে আরও মিশে যেতে চান। যেন বলতে চান, ‘আমি কিন্তু তোমাদেরই লোক’। 

একটা সময়ে ড্রেসিংরুমে মেসিকে আদর করে সবাই ডাকতেন, ‘পুলগা’ বলে। পর্তুগিজ ভাষায় তার মানে ‘মাছি ‘। সদাব্যস্ত, ছোট্ট চেহারার, যাকে ধরা কঠিন। এখন সতীর্থরা মেসির নাম দিয়েছেন ‘বেজি’। সহজে হার মানেন না। এরপরের নাম কলমচিরা ঠিক করে রেখেছেন গোট (জি ও এ টি)। গোট মানে ছাগল নয়। গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম। এ বার ট্রফি হাতে নিলে আর্জেন্টিনার মানুষ স্বীকার করে নেবেন, তাঁদের দেশের সেরা ফুটবলার হয়তো মারাদোনা নন। মারদোনার ক্লোন নিজের শরীরে নিয়ে একেবারে বদলে ফেলা লিওনেল মেসি। 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 





Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *