শুভপম সাহা: ‘রুকে না তু, থকে না তু/ ঝুকে না তু, থামে না তু/ সদা চলে থকে না তু/ রুকে না তু, ঝুকে না তু’! বিংশ শতকে হিন্দি ভাষার বিখ্যাত কবি হরিবংশ রাই বচ্চনের বিখ্যাত কবিতা ‘রুকে না তু/ ঝুকে না তু’। জনপ্রিয় এই কবিতা দিয়েই লিওনেল মেসির (Lionel Messi) পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করা যায়। না থেমে, না ঝুঁকে এগিয়ে চলার নামই তো মেসি। আবার একবার দেখিয়ে দিলেন তিনি। আর্জেন্টিনার (Argentina) ‘মেসিহা’ কাতারে (FIFA World Cup 2022) বুঝিয়ে দিলেন তিনি আসলে ছোটখাটো চেহারার এক সামুরাই যোদ্ধা। যাঁর কোড নেম এলএমটেন (LM10)। এই মেসির বয়স কিন্তু আর কুড়ির ঘরে ঘোরাফেরা করে না। তাঁর বয়স এখন ৩৫! অথচ গোটা বিশ্বকাপে তাঁর খেলা দেখে মনে হয়েছে, যেন কোনও তরুণ তুর্কি খেলছেন, দেখাচ্ছেন নীল-সাদা ম্যাজিক। মেসি পুরো নব্বই মিনিট তো খেলেছেনই, এছাড়া যে যে ম্যাচ নির্ধারিত সময়ের পর এক্সট্রা টাইম ও টাইব্রেকারে গড়িয়েছে, সেই ম্যাচেও তিনি খেলেছেন বুক ফুলিয়ে। একবারের জন্যও তাঁকে সাবস্টিটিউট করে বেঞ্চে বসাতে হয়নি কোচ লিওনেল স্কালোনি (Lionel Scaloni)।
আরও পড়ুন: Watch | Lionel Messi: আরব সাগরের ১০০ ফুট গভীরে দাঁড়িয়ে LM10! ভাইরাল ভিডিয়ো দেখে থ ফুটবলবিশ্ব
গোটা মাঠ জুড়ে মেসি। প্রয়োজনে উঠেছেন, প্রয়োজনে নেমেছেন। আচমকাই বক্সে ঢুকে প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছেন। ত্রাসের সঞ্চার করেছেন এক লহমায়। কোমরের ছোট্ট দোলায় বোকা বানিয়েছেন একাধিক হাঁটুর বয়সি ডিফেন্ডারদের। ম্যান মার্কিং করা হয়েছে মেসিকে, যেমনটা করা হয়ে এসেছে তাঁকে আজীবন। একের বিরুদ্ধে কখনও দুই, তো কখনও চার! তবুও রোখা যায়নি এই মেসিকে। রোখা যায়ও না। হয় নিজে দুরন্ত গোল করেছেন, নয় গোলের জন্য সতীর্থদের একদম বল সাজিয়ে দিয়েছেন। মেসি বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচে গড়ে ৮.৮ কিমি পথ অতিক্রম করেছেন। ম্যাচ পিছু তাঁর স্প্রিন্ট রেট ৩৫.৫! মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো পরিসংখ্যান তাঁর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, মেসি কী করেও এই বয়সে ভয়ংকর ফিট? কোন মন্ত্রে তিনি বয়সকে বুটের তলায় পিষে দিয়ে ছুটে চলেছেন! জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটালের এই প্রশ্নই ছিল ডক্টর বিদ্যা রায়ের কাছে। যিনি শারীরবিদ্যা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিষয়ক সহাকারি অধ্যাপক। পাশাপাশি জুম্বা ও যোগা বিশেষজ্ঞও। বিদ্যা মেসি ম্যাজিক দেখেছেন বিশ্বকাপে। তিনি উপভোগ করেছেন এলএম টেনের খেলা। টেলিফোনে বিদ্যা বলছেন যে, মেসির এনডিওরেন্সের জন্য রয়েছে কয়েকটি ফ্যাক্টর।
কী কী বললেন বিদ্যা?
১) জেনেটিক ফ্যাক্টর: পূর্বপুরুষদের জিন কাজ করে মেসির ক্ষেত্রে। কার্ডিও ভাসকুলার এনডিওরেন্স না থাকলে, এই ভাবে মেসির পক্ষে দৌড় সম্ভব হত না। এত লম্বা সময় ধরে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে পারতেন না। মেসি অপ্রতিরোধ্য। কোনও ক্লান্তি তাঁকে ছুঁতে পারেনি। ব্যাক-টু-ব্যাক খেলেছেন। গোল করেছেন এবং করিয়েছেন। এটা জেনেটিক ফ্যাক্টরের জন্যই সম্ভব। নাহলে হত না।
২) আরবিসি মাসল: রেড মাসল ফাইবার বেশি রয়েছে মেসির। যা তৈরি হচ্ছেও। এর ফলে এনডিওরেন্স বাড়ে। যে কারণে আর পাঁচজন মানুষের থেকে বেশি দৌড়তে পারেন মেসি। এক কথায় মোর স্ট্যামিনা, মোর এনডিওরেন্স। মেসির ক্ষেত্রে এই কথাই প্রযোজ্য।
৩) প্র্যাক্টিস ও অভিজ্ঞতা: বছরের পর বছর অনুশীলনের পরেই সম্ভব হয়েছে এমনটা। তাঁর অভিজ্ঞতা এখন আকাশচুম্বী। এর সঙ্গেই রয়েছে কঠোর ডায়েট ও মেসির লাইফস্টাইল। সার্বিক ভাবেই ওর শরীর কথা বলে। নাহলে মেসি হওয়া যায় না।
৪) মানসিক স্বাস্থ্য: অবশ্যই রয়েছে মেন্টাল হেলথ। মনকে কোনও ভাবেই দুর্বল হতে দিলে চলবে না। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাইনালে যখন এমবাপের তৃতীয় গোলে ফ্রান্স ৩-৩ করেছিল স্কোরলাইন। তখনও কিন্তু মেসি ভেঙে পড়েননি। খেয়াল করে দেখবেন, মেসি একদম কুল ছিলেন। উনি হাসছিলেন। খুব স্পোর্টিংলি নিয়েই আবার নিজের খেলা শুরু করে দিলেন। কোনও চাপই নিলেন না।
একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে এবার। সাল ১৯৮৭, তারিখ ২৪ জুন। আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মানো বাচ্চাটা পায়ের সমস্যার জন্য বছরে পর বছর ভুগেছিল। মাত্র ১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি ( হরমোনের প্রভাবে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেমে যাওয়া) ধরা পড়েছিল। রাতের পর রাত পায়ের মধ্যে সূঁচ ফুটিয়ে চিকিৎসা। এক-আধ বছর নয়, তিন বছর এভাবেই চলেছিল। পিট্যুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের তারতম্যের জেন্যে তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি থেমেছিল একটা সময়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বাচ্চাটা সেরে ওঠে। পরে তাঁর ওই পা-ই গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে দিল। আজ বাঁ-পায়ের জাদুকরের পায়ে মাথা নত করছে গোটা বিশ্ব। মেসি মানেই আবেগের বিস্ফোরণ। যা চলছে…চলবে…আপাতত।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)