নবম-দশমে এসএসসি-র নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় সিবিআই চার্জশিট দিলেও বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগে অভিযুক্ত সরকারি আধিকারিকদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের তরফে কনসেন্ট বা অনুমতি দরকার। দুর্নীতি দমন আইনেই এই সংস্থান আছে। সেই কনসেন্ট এখনও কেন মেলেনি, সিবিআই (CBI) কৌঁসুলির কাছে দিনকয়েক আগে তা জানতে চেয়েছিলেন আলিপুর আদালতের বিচারক। ডিভিশন বেঞ্চ বুধবার মুখ্যসচিবের উদ্দেশে বলে – সৎ ও সাহসী অফিসারদের যাতে অযৌক্তিক এবং অপ্রীতিকর মামলার মুখে অযথা পড়তে না-হয়, সে জন্যই রাজ্যের অনুমতির বিষয়টি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণও জমা দেওয়া হয়েছে কোর্টে। তাই আদালত আশা ও বিশ্বাস করে, রাজ্য সরকার এই বিষয়গুলি বিবেচনা করে অনুমতির ব্যাপারে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
নিয়োগ-দুর্নীতির ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আদালত এতটাই ক্ষুব্ধ যে বিচারপতিদের বেঞ্চ জানায়, আগামী এক বছরের মধ্যে আর এই জামিনের আবেদন তারা শুনবে না। কোর্ট এ দিন এসএসসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যানের জামিন-আর্জি খারিজ করতে গিয়ে লিখিত রায়ে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছে। এতে বর্ষীয়ান আইনজীবীদের অনেকের ধারণা, বিচারপতি বাগচির ডিভিশন বেঞ্চের এ দিনের নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ শিক্ষায় নিয়োগ-দুর্নীতিতে ধৃত বাকি অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে তুলে ধরবে তদন্তকারী সংস্থা। আজ, বৃহস্পতিবার এই ডিভিশন বেঞ্চেই আবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের জামিনের শুনানির কথা।
বুধবার সুবীরেশের হয়ে আইনজীবী অমলেশ রায় আদালতে দাবি করেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে তেমন কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। কেবল ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পর্ণা বসুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, সুবীরেশের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ, তার বিস্তারিত রিপোর্ট কোর্টে জমা দেয় সিবিআই। তদন্তকারী সংস্থার কৌঁসুলি অরুণ মাইতি ও অনির্বাণ মিত্র দাবি করেন, পার্সোনালিটি টেস্টের নম্বর নয়ছয়, ওএমআর শিটে নম্বর বদল – সবই হয়েছে অভিযুক্তের নির্দেশে। তাতে সুবীরেশের আইনজীবী আপত্তি জানানোর চেষ্টা করেন। এর প্রেক্ষিতেই ঘুমের প্রসঙ্গ টানে বেঞ্চ। অভিযুক্তের আইনজীবীর উদ্দেশে বেঞ্চের পাল্টা প্রশ্ন – ষড়যন্ত্রকারী কি কোনও প্রমাণ রাখতে চায়? এটা বিশ্বাসযোগ্য? এত ঘটনা ঘটেছে, অথচ আপনি কিছুই জানতেন না! দুর্নীতি ঢাকা দিয়েই হয়!
ডাকঘর থেকে টাকা তছরুপ হলে যে পোস্ট মাস্টারের উপরে দায় বর্তায় – সুবীরেশের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেই উদাহরণও তুলে ধরে আদালত। বেঞ্চের মন্তব্য – একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির হাতে একটা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের ভার দিয়ে সমাজ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। আবার, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এজ- লাসে অন্য একটি মামলার শুনানি চলাকালীন জানতে চেয়েছিলেন, সুবীরেশ সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে সহযোগিতা করছেন কি না। সহযোগিতা না-করলে আদালত কঠোর পদক্ষেপ করবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন। বুধবার নিয়োগ-দুর্নীতির অন্য একটি মামলায় জালিয়াতির নথি দেখে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘এটা হতে পারে! কে ছিলেন তখন চেয়ারম্যান?’ আইনজীবী জানান, সুবীরেশই তখন এসএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন। বিচারপতির প্রশ্ন, ‘এটা কী করে হয়! এসএসসি এত দুর্নীতি করতে পারে!’ তারপরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘শুনলাম, আজ তাঁর (সুবীরেশ ভট্টাচার্য) জামিনের আবেদন ডিভিশন বেঞ্চ খারিজ করে কিছু অবজারভেশন দিয়েছে।’
এর আগেই অবশ্য ডিভিশন বেঞ্চ তার রায়ে জানায়, সুবীরেশ এসএসসির চেয়ারম্যান থাকাকালীনই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে। নিয়োগের নামে তিনি অস্বচ্ছতার পথ নিয়েছেন। আদালতে সিবিআইয়ের দাবি – মেধাতালিকা প্রকাশের আগে ওএমআর শিটে নম্বর বদল করতে তিনিই নির্দেশ দিতেন। ডেটা বেসও নিয়ন্ত্রণ করতেন সুবীরেশ। প্রতিষ্ঠানের মাথা হিসেবে তিনি প্রতিদিনের কাজ চালাতেন। এবং মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সরকারি পদের তিনি অযোগ্য। একজন শিক্ষাকর্তা হয়েও তিনি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিতে মদত দিয়ে রাজ্যে শিক্ষার ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন। ধাপ্পাবাজি করেছেন সমাজের সঙ্গে। সম্ভব হলে টার্নের হেডিং – এক বছরে জামিন-আর্জি শুনবে না ডিভিশন বেঞ্চ।