গত কয়েক মাসে মালদা (Malda) উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কয়েকটি মাদ্রাসার পরিচালন সমিতির নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীরা (TMC) পরাজিত হয়েছেন। সেগুলোর কয়েকটি বাম-কংগ্রেস (CPIM-Congress) জোট জিতেছে, আবার অন্য কয়েকটিতে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে একক ভাবে। যদিও দেড় বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে একদা কংগ্রেসের ঐতিহ্যশালী ঘাঁটি মালদায় দেশের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। মালদারই সুজাপুর বিধানসভা কেন্দ্রে গনিখান চৌধুরীর পরিবারের ইশা খান চৌধুরী ১ লক্ষ ৩০ হাজারের বেশি ভোটের রেকর্ড ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী আব্দুল গনির কাছে। সেই মালদা জেলার কয়েকটি মাদ্রাসার পরিচালন সমিতির নির্বাচনে তৃণমূলের সাম্প্রতিক পরাজয় দেখে কংগ্রেসেরই কয়েক জন নেতা বিস্মিত। ঠিক যেমন বিধানসভা ভোটের মাস ছয়েকের মাথায় সামশেরগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট শেয়ার এক ধাক্কায় বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ হওয়ায় বিধান ভবনের কর্তারাও চমকে গিয়েছিলেন, তেমন। অথচ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর জেলার মতো কংগ্রেসের একদা দুর্গগুলিতে কংগ্রেসের বহু প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
অন্য একটি ঘটনাও উত্তরবঙ্গের রাজনীতিবিদদের একাংশের চোখে পড়েছে। দীপা দাশমুন্সি প্রায়শই রাজ্যের বাইরে থাকার কারণে উত্তর দিনাজপুর (Uttar Dinajpur) জেলার রায়গঞ্জ লোকসভা (Raiganj Lok Sabha) কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে কংগ্রেসের কর্মসূচি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট হওয়া ইস্তক তেমন দেখা যায়নি। বিধানসভা নির্বাচনের পর আপাত দৃষ্টিতে কংগ্রেসের ঝান্ডা হাতে সভা দূরের কথা, ছোটখাটো মিছিলও দেখা যায়নি। সেই জায়গায় ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আলি ইমরান রামজ ওরফে ভিক্টর, হাফিজ আলম সাইরানি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর ইসলামপুর মহকুমায় কংগ্রেস হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে। টুকরো টুকরো এই সব ঘটনার কারণেই কি মুরলীধর সেন লেনে বঙ্গ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের নিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠকে খোদ অমিত শাহ সিপিএমের পাশাপাশি বাংলায় কংগ্রেসের কী হাল, সেই প্রশ্ন করেছিলেন?
প্রবীণ কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, ‘বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে সর্বভারতীয় পরিসরে কংগ্রেস তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০১৯ সালে যেখানে শক্তিশালী সংগঠন থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও রাজ্যে কংগ্রেস একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে দু’টি আসন পেয়েছিল। বাংলায় কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি হলে জাতীয় স্তরে বিজেপির মোট আসন কমবে। দেড় বছর আগে রাজ্যে যে সমীকরণ ছিল, তার বদল হচ্ছে। তাই অমিত শাহদের উদ্বেগ বাড়ছে।’ তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান তথা সাংসদ আবু তাহেরের কথায়, ‘কংগ্রেসের মিছিল-মিটিংয়ে কিন্তু লোক হচ্ছে। বিশেষ করে, যে অংশের মানুষ কোনও কারণে তৃণমূলের প্রতি অসন্তুষ্ট অথচ বিজেপি-বিরোধী, তাঁরা কংগ্রেসের মিছিলে যাচ্ছেন। বিধানসভায় শূন্য হয়ে যাওয়ার পর কংগ্রেসের যাঁরা বসে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও একাংশ ফের সক্রিয় হচ্ছেন।’
তবে উত্তর দিনাজপুরে কংগ্রেসের সক্রিয়তা বাড়লেও তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না গোয়ালপোখরের দাপুটে নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী গোলাম রাব্বানি। তাঁর কথায়, ‘উত্তর দিনাজপুরে আমরা যতদিন ছিলাম, কংগ্রেস ছিল। আমরা কংগ্রেস ছাড়ার পর কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব নেই। ভিক্টর যোগ দিলেও কোনও প্রভাব পড়বে না।’ রাব্বানি এই যুক্তি দিলেও ওই জেলার অন্য বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ তৃণমূল নেতা আব্দুল করিম চৌধুরী সঙ্গে দলের একাংশের মতপার্থক্য বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের বক্তব্য।
২০১৯ সালে উত্তর দিনাজপুর ও মালদায় কংগ্রেসের গড়ে বিজেপি দু’টি আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল। এআইসিসি সূত্রের খবর, ২০২৪ সালের দিকে তাকিয়ে রাজ্যের ১০-১২টি আসনকে দল টার্গেট করেছে। কমবেশি ৫-৬ আসনে কংগ্রেস জয়ী হতে চাইছে। পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকিয়ে বিধান ভবন যে ইলেকশন কমিটি তৈরি করেছে, তার অন্যতম সদস্য, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তারের কথায়, ‘মালদায় মাদ্রাসার পরিচালন সমিতির নির্বাচনের ফল যদি ইঙ্গিতবাহী হয়, তা হলে পরিস্থিতির গুণগত বদল হচ্ছে। লোকসভা ভোটে জাতীয় স্তরে বিজেপিকে ঠেকাতে পারে কংগ্রেসই- এটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বোঝেন।’ যদিও বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘এই রাজ্যে যাঁরা তৃণমূলকে হারাতে চাইবেন, তাঁরা বিজেপিকে ভোট দেবেন। যাঁরা বিজেপিকে হারাতে চাইবেন, তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেবেন। এই সমীকরণে কোনও বদল হবে না।’ তবে বঙ্গ বিজেপিরই অন্য এক হেভিওয়েট নেতার বক্তব্য, ‘মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরে সংখ্যালঘু ভোট ২০২৪ সালে কার সঙ্গে থাকবে, তার ইঙ্গিত মিলবে পঞ্চায়েত নির্বাচনেই।’