ব্যাঙ নেই, সাদা ইঁদুর নেই, নেই পর্যাপ্ত কেমিক্যাল। জলফড়িংও বাড়ন্ত! ফলে ল্যাবরেটরিতে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস (Practical Class) প্রায় বন্ধের মুখে। আবার সাত-আট মাস কেটে গেলেও রসায়ন বিভাগের স্পেকটোমিটার যন্ত্র (Spectrometer) খারাপ। সারাই করার টাকা নেই। এমনই অবস্থা যে, শিক্ষকদের নিজেদের পকেট থেকে টাকা খরচ করে পড়ুয়াদের নিয়ে যেতে হচ্ছে শিক্ষামূলক ভ্রমণে। প্রতি সেমেস্টার পিছু বিভাগগুলির যে টাকা পাওয়ার কথা, তার অর্ধেকও জুটছে না। ফলে অনেক বিভাগের হাতেই প্রতিদিনের খরচ চালানোর রসদ নেই। সেমিনার, আলোচনা সভা- সবই প্রায় বন্ধের মুখে। সর্বোপরি অধ্যাপকদের গবেষণা খাতে বিশেষ অনুদানও বন্ধ। এমনই অভিযোগ সামনে এসেছে রাজ্যের পাঁচতারা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের (Presidency University)অন্দর থেকে। যা নিয়ে পড়ুয়া থেকে শিক্ষক প্রত্যেকেরই মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কেন প্রেসিডেন্সির এমন অবস্থা, তা নিয়ে যথোপযুক্ত উত্তর পাওয়া যায়নি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। তবে একটি সূত্রের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে টাকা নেই। ফলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পঠন-পাঠন ও গবেষণায়। এই সমস্যা ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের ফি ন্যূনতম ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা ভাবছেন। যদিও এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থার অনুমোদনের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়ার ফোন ‘আনরিচেবল’। আর রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনারকে ফোন, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ করে সব জানানো হলেও তিনি মুখ খুলতে নারাজ।
এ দিকে বিভাগগুলিতে যেন কার্যত হাহাকার তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বিজ্ঞান শাখায় (Science)। সেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস কার্যত থমকে। জীবন বিজ্ঞান বিভাগে (Biology) প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে গেলে যে সব প্রাণীর ব্যবচ্ছেদ সিলেবাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেগুলির কেনারও টাকা নেই। এক অধ্যাপক জানান, প্রতি সেমেস্টারে তাঁদের দু’লক্ষ টাকা করে পাওয়ার কথা। কিন্তু জুটেছে মাত্র ৫০ হাজার! ফলে যেটুকু ব্যাঙ, ইঁদুর, জলফড়িং আছে, তা দিয়ে কেবল শিক্ষকরা ব্যবচ্ছেদ করে পড়ুয়াদের দেখাচ্ছেন। পড়ুয়ারা নিজের হাতে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ। বিজ্ঞান শাখার ডিন শঙ্কর বসু বলেন, ‘অর্থ সঙ্কটে যে সব সমস্যা প্রকট হওয়ার কথা, সেগুলিই হয়েছে। আমরা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি।’
অন্য দিকে, জীবন বিজ্ঞান, ভূগোল, জিওলজির মতো যে সব বিষয়ে ফিল্ডও সিলেবাসের অংশ, সেখানেও অধ্যাপকদের ভ্রমণের খরচ দিনের পর দিন ধরে মিলছে না। কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়েছেন, নিজেদের টাকা থেকে ঘুরে আসুন। পরে টাকা পেলে দিয়ে দেওয়া হবে। রসায়নের প্র্যাক্টিক্যালের যন্ত্র খারাপ মাসের পর মাস। তা ঠিক করা হচ্ছে না। বদলে একটু কম দামি যন্ত্র কেনার জন্য জানানো হলেও তারও টাকা বরাদ্দ করা হয়নি। কলা শাখার ক্ষেত্রেও সমস্যা প্রবল। সেখানে সেমিনার আয়োজনের বরাদ্দটুকু নেই। সে ক্ষেত্রে অতিথিদের নিয়ে আসার খরচ কমাতে অনলাইনে আলোচনার আয়োজন করতে হচ্ছে। অথবা ভিনরাজ্যের বা দেশের গবেষক-অধ্যাপকরা যখন অন্য কোনও কাজে কলকাতা আসছেন, তা ট্র্যাক করে তাঁদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে হচ্ছে প্রেসিডেন্সিতে এসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করার পর দেশ-বিদেশ থেকে যখন অধ্যাপকদের নিয়ে আসা হয়, তখন থেকে তাঁদের গবেষণা খাতে উৎসাহের জন্য একটি বিশেষ উৎসাহ ভাতা দেওয়া হতো। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের জন্য ১ লক্ষ, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের জন্য ২ লক্ষ এবং প্রফেসরদের জন্য ৩ লক্ষ টাকা বার্ষিক বরাদ্দ করা হতো। সেটাও বন্ধ রয়েছে। চলতি বছর সব স্তরেই মাত্র ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কলা শাখার ডিন সুমিত চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘এই টাকা অধ্যাপকদের আশু প্রয়োজন।’
এই পরিস্থিতির জন্য কি সরকারি তহবিলে কোনও সমস্যা রয়েছে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও অর্থসঙ্কট নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। কিন্তু সেখানে কর্তৃপক্ষ সরকার ও প্রাক্তনীদের চিঠি লিখে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে সেই সাহায্য পাওয়াও গিয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে এমন কোনও দাবি উচ্চশিক্ষা দপ্তরে করা হয়নি বলে সূত্রের খবর। দপ্তরের এক কর্তা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের কেউই কখনও এই অবস্থার কথা জানাননি। বরং সব ঠিক চলছে কি না জানতে চাইলে বার বারই উত্তর দেওয়া হয়েছে, খুব ভালো চলছে।’ খুব ভালো চললে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসের জন্য ব্যাঙ, ইঁদুর কেনার টাকা নেই কেন? সদুত্তর মেলেনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।