বিতর্কিত ক্যালেন্ডারে রয়েছে এক বিচিত্র উপক্রমণিকা। সেখানে দাবি করা হয়েছে, পশ্চিমে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভব, সেটা প্রাচ্য থেকেই পাওয়া। প্রাচ্যের ভাবনায় আরোহণ করেই পশ্চিমের যাত্রা। ভারতীয় গণিত, সংস্কৃতি এবং ভাষাচর্চাই নাকি সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপকে শিক্ষিত করেছে। যা মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের পথে ইউরোপকে সভ্য করেছে। এই সূত্রেই পরবর্তীতে আধুনিক আমেরিকান সভ্যতারও জন্ম। ইউরোপ ও আমেরিকার সভ্যতার মূল রসদ সংগৃহীত হয়েছে প্রাচ্য থেকেই। তবে পশ্চিমের উপনিবেশবাদ সেই সত্যকে অস্বীকার করে চূড়ান্ত বস্তুবাদী ও ভোগবাদী এক সংস্কৃতি বিজ্ঞানের নামে চাপিয়েছে ডারউইন, ফ্রয়েড, মার্কস, রেনে দেকার্ত, নিউটন এবং কেপলারদের ‘যান্ত্রিক মডেলে’। এই মডেলে নীতি, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং মানবিকতা বিসর্জিত হয়েছে। ভারতেও এর কুফল ফলেছে।
খড়গপুর আইআইটির (IIT Kharagpur) মতো আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজগুবি গল্প ও পুরাণ-কথাকে বিজ্ঞানের নামে বার্ষিক ক্যালেন্ডারে প্রকাশ করেছে বলে সরব হয়েছেন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানমনস্করা বার বার সমালোচনা করা সত্ত্বেও তাতে কর্ণপাত না করে আরও এক ধাপ এগিয়ে IIT ২০২৩-এর ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে বিকৃত তথ্য-তত্ত্বের সন্নিবেশে। ঘটনা হলো, ইউরোপের নবজাগরণের মধ্য দিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা। যার ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং অর্থনীতি-সহ সব ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। সেই বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেই শিল্পায়ন হয়েছে। অথচ এই ক্যালেন্ডার সে-সবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। হাস্যকর ভাবে ভারতকে বেবাক জ্ঞানের উৎস হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তা করতে গিয়ে বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গকে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা-ও আবার রবীন্দ্রনাথের নাম জুড়ে। ফলে স্বনামধন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গরিমাই কালিমালিপ্ত হয়েছে।
বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আশিস লাহিড়ীর বক্তব্য, “ক্যালেন্ডার কম্পোজ করেছেন IIT-র টাউন প্ল্যানিং বিশেষজ্ঞ জয় সেন। দেশের কোনও সংস্থা টাউন প্ল্যানিং বিষয়ে কোনও ইতিহাসবিদকে দিয়ে লেখালে জয় সেনরা কী বলতেন! পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে হাইজেনবার্গ ও স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে নিকোলা টেসলার কথোপথন বিষয়ে যে তথ্য ক্যালেন্ডারে পরিবেশন করা হয়েছে, তা-ও অর্ধসত্য। মিথ্যার চেয়েও যা বিপজ্জনক।” সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, “অবিলম্বে এই ধরনের ক্যালেন্ডার বাতিল করা উচিত। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ধারায় আইআইটি খড়গপুরের (IIT Kharagpur) বিশ্বব্যাপী সুনাম, তা নিয়ে ছেলেখেলা বন্ধ হোক।”
যদিও জয় সেন এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেছেন, “ভারতীয়দের একাংশ এখনও ৪০০ বছর আগের নিউটনের প্রাচীন বিজ্ঞান-তত্ত্ব নিয়ে পড়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথকে হাইজেনবার্গ বলেছিলেন, আমরা ল্যাবে গবেষণা করে ও অঙ্ক কষে যে কঠিন বিজ্ঞান তুলে ধরি, আপনি কবিতার মাধ্যমে সহজেই তার হিসাব বলে দেন কী ভাবে? পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা ঘুরপথে যে বৃহত্তর সত্য খুঁজে বার করেন, ভারতীয় ঋষিরা সনাতন কাল থেকেই তা ধ্যানের মাধ্যমে খুঁজে বার করেন।” প্রতিবাদীদের পাল্টা কটাক্ষ, কোনও রকম তথ্যসূত্র ও ব্যাখ্যা ছাড়া মনগড়া তত্ত্ব আউড়ে এ সবই আসলে IIT হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।