সব্যসাচী বাগচী
খেলাধুলার জগতে আলাদা স্বাদের স্টোরির অভাব নেই। গত কয়েক বছরে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ (U19 World Cup) থেকে শুরু করে আইপিএল (IPL), লড়াই করে প্রতিভাবানদের উঠে আসার ঘটনা অনেকেই জানেন। উদবুদ্ধ হন। তবে অর্চনা দেবীর (Archana Devi) জীবনের উত্থান-পতন, কঠিন পথের বাঁক, মায়ের প্রতি লাঞ্ছনার গল্প পড়লে আপনি কিছুক্ষণ ভাবতে বাধ্য হবেন। কারণ ‘ডাইনি’-র মেয়ে যে বিশ্বজয়ী হয়েছেন! একদম নিজের দমে ভারতের মহিলা দলকে (Indian Womens Under 19 Cricket Team) বিশ্বজয়ী করেছেন ১৮ বছরের তরুণী।
গোটা দুনিয়া দেখেছে অর্চনাকে। অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (ICC Women U19 T20 World Cup 2023) মেগা ফাইনালে ইংল্যান্ডের (England Womens Under 19 Cricket Team) টপ অর্ডারকে বুঝে নিয়েছিলেন এই অফ স্পিনার। নিলেন ১৭ রানে ২ উইকেট। তবে এই অর্চনা ও তাঁর পরিবারকে আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের লোকজনদের কাছ থেকে সহ্য করেছেন অপমান। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের রাতাই পুর্বা গ্রামের এই পরিবারকে ‘একঘরে’ করে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু অর্চনার মায়ের অপরাধ? অর্চনার বাবা শিবরাম ২০০৮ সালে ক্যান্সারের কারণে মারা যান। সেই শোক কাটিয়ে উঠে সংসার কিছুটা দাঁড়াতেই, ২০১৭ সালে ভারতীয় দলের এই ক্রিকেটারের পরিবারে নেমে আসে ফের অন্ধকার। সাবিত্রীর ছোট ছেলে সাপের কামড়ে মারা যান। সেটা ২০১৭ সালের ঘটনা। এরপর থেকেই গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা সাবিত্রী ও তাঁর পরিবারকে দূরে ঠেলে দেন। ‘ডাইনি’ অপবাদে করে দেওয়া হয়েছিল একঘরে। তবে অর্চনা ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে অবস্থার বদল হয়েছে। এবং সেই অবস্থার আরও বদল ঘটল মেয়ে বিশ্বজয়ী হওয়ার পর থেকে।
পরিবারের সেই অস্থির সময়, ‘ডাইনি’ অপবাদ শুনে একটা সময় কাঁদতেন সাবিত্রী। কতটা কঠিন ছিল সেই সময়? অর্চনার মা জি ২৪ ঘণ্টাকে বলছিলেন, “ওর বাবা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর ছোট ছেলেটাও চলে গেল। সেই কষ্ট নিয়েই সন্তানদের মানুষ করতে শুরু করি। এরমধ্যে সমস্যা বাড়ল আমাকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে, পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে কেউ হাঁটাচলা করত না। এমনকি আমাদের ছায়া দেখলেও লোকজন সরে যেত! এখন সেই চেনা মুখগুলোই আমাদের ঘরে ভিড় করেছে। লাড্ডু নিয়ে এসেছে আমার মুখে তুলে দিচ্ছে!”
ইংল্যান্ডের ইনিংসের শুরুতেই গ্রেস স্ক্রাইভেনস এবং নিয়াম হল্যান্ডকে ফিরিয়ে জোড়া ধাক্কা দেন। সঙ্গে ছিল দুরন্ত ফিল্ডিং। অর্চনা এমন পারফরম্যান্স করে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে ম্যাচে মেয়ে কেমন পারফর্ম করেছিল, সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না ওঁর মা সাবিত্রী।
বরং টেনে আনলেন অর্চনার ছোটবেলার কথা। পরিবারে আর্থিক অভাব থাকলেও, মেয়ের ক্রিকেট প্যাশনকে সম্মান জানিয়েছিলেন ওঁর মা। স্থানীয় কস্তুরবা গান্ধী আবাসিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। এই স্কুলটি অর্চনার গ্রাম থেকে প্রায় ২৫ কিলমিটার দূরে ছিল। তাই মেয়েকে ক্রিকেট খেলানোর জন্য মেয়েদের বোর্ডিংয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। পুরো ব্যাপারে সাবিত্রীকে সাহায্য করেছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার ও অর্চনার ‘মেন্টর’ পুনম গুপ্তা। সেই সময়ও গ্রামের কিছু লোকজন সাবিত্রীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন।
সেই অন্ধকার দিনগুলো নিয়ে সাবিত্রীর প্রতিক্রিয়া, “আমি নাকি টাকার বিনিময়ে মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছি! নিজে খারাপ মানুষদের খপ্পরে পরে অর্চনাকে কিছু সন্দেহজনক ডিলারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি! এতকিছুর পরেও আমরা কিন্তু হাল ছাড়িনি।”
গ্রামের বড় হলেও অর্চনার মানসিকতা ছিল একেবারে শহুরে। মেয়েদের ড্রেস গায়ে চাপাতেন না। বরং জিন্স ও টি-শার্ট ছিল ওঁর প্রথম পছন্দ। বোনের ক্রিকেট প্রেমের কথা জানতেন ওঁর দাদা রোহিত কুমার। সেই দাদা মা সাবিত্রী রাজি করানোর ব্যাপারে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাকি পথটা নিজেই হেঁটেছেন অর্চনা। আর সেই সময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কপিল দেব পান্ডে। টিম ইন্ডিয়ার তারকা স্পিনার কুলদীপ যাদবের ছোটবেলার কোচও অর্চনাকে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর।
এহেন কপিল দেব পান্ডে টেলিফোনে বলেন, “অর্চনা ছোটবেলা থেকে দারিদ্রতা দেখেছে। অনেক অপমান সহ্য করেছে। সেই কঠিন দিনগুলোই ওকে আরও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। এবং সেটাই ওর এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার। ওকে ঘষেমেজে তৈরি করার বিশ্বকাপ জিতেছে। ফাইনালে পারফর্ম করেছে। একজন কোচের কাছ থেকে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কিছুই নেই।”
কপিল দেব পান্ডের কাছে যাওয়ার আগে অর্চনা জোরে বোলিং করতেন। তবে সেখানে যাওয়ার পরেই ছাত্রী বোলিং স্টাইল বদলে দেন তিনি। পেস বোলার থেকে অফ স্পিনার হয়ে ওঠেন অর্চনা। ভাগ্যিস হয়েছিলেন। নাহলে কাপ যুদ্ধের ফাইনালে অফ স্পিনার অর্চনাকে যে দেখাই যেত না।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)