কথায় বলে, ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা।’ জগতের তাবৎ জিনিসপত্র যা অন্যের, সেটা মালিককে না জানিয়ে নিলে তাকে চুরি করা বললেও ‘মন’ আর ‘বই’— এই দুটো জিনিস চুরি করলে বোধহয় তা খুব বড় অপরাধ বলে গণ্য হয় না! বই যাঁরা পড়েন, সংগ্রহ করেন তাঁদের অনেকের বাড়িতে খুঁজলেই ‘চুরিকরা’ বই পাওয়া যাবে। সবাই যে সরাসরি চুরি করেন তেমন না হলেও, অন্যের বই পড়তে এনে নিজের মনে করে রেখে দেওয়ার ঘটনাও হতে পারে! বইমেলার গোড়ার দিকে এই বইচুরি আটকানো বিক্রেতাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তখন মেলার সিকিউরিটি এত আঁটোসাঁটো ছিল না আর নজরদারি ক্যামেরা যে কী বস্তু সেটার ধারনাও কারোর ছিল না। ফলে বড় প্রকাশকেরা তো বটেই, মাঝারি, ছোটো প্রকাশকদেরও বইচুরি আটকাবার জন্য আলাদা লোক রাখতে হত। তাতেও যে শেষরক্ষা হত, তা নয়। কিছুকাল পরে নিয়ম করা হল, মেলার মাঠ থেকে বেরোবার সময়ে ‘বাহির পথ’-এ বই কেনবার প্রমাণ হিসেবে রসিদ দেখাতে হবে। এবং মেলা কর্তৃপক্ষ বারংবার মাইক্রোফোনে বই কেনবার সময়ে রসিদ সংগ্রহ করবার অনুরোধ জানাত। তাতেও যে বইচুরি একেবারে বন্ধ করা গিয়েছিল, তেমনটা নয়! তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথাকথিত ‘বইচোর’দের তেমন কোনও শাস্তি দেওয়া হত না বা পুলিশকেও জানানো হত না।
ছোটখাট কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে, এখনকার বইমেলায় অবশ্য বইচুরির অভিযোগ তেমন আর পাওয়া যায় না। ‘বই কেনার সময়ে রসিদ নিতে ভুলবেন না’ গোছের ঘোষণাও বহুকাল আর বইমেলায় শোনা যায় না! তবে এখন চুরিটা অন্য জায়গায়। অন্যের লেখা চুরি করে বহু মানুষ যেমন ফেসবুক বা ব্লগে পোস্ট করে নিজের লেখা বলে জাহির করেন, তেমনই কপিরাইট লঙ্ঘন করে অন্যের লেখা বই থেকে হুবহু টুকে নিজের নামে বই ছেপে বের করবার অভিযোগও আজকাল ভীষণ ভাবে বেড়ে গেছে। কিছুকাল আগেই এক তরুণ লেখকের গল্পের প্লট ব্যবহার করে উপন্যাস লেখার অভিযোগ উঠেছিল এক স্বনামধন্য লেখকের বিরুদ্ধে। শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রে ‘প্লেজিয়ারাইজিং’ আটকাবার সফ্টওয়্যার থাকলেও বাংলা ভাষার বইবাজারে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-কবিতার চুরি আটকাবার তেমন শক্তপোক্ত কোনও ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেই। ফলে লেখা চুরি বেড়ে গেছে যথেচ্ছ ভাবে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ অবশ্য এ ব্যাপারে বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গের থেকে একটু এগিয়েই আছে।
গবেষক-প্রাবন্ধিক সৌম্য বসু অভিযোগ করেছেন, তাঁর লেখা ‘দাঙ্গা থেকে দেশভাগ: হিন্দু বাঙালির প্রতিক্রিয়া’ ও ‘দাঙ্গা থেকে দেশভাগ: মুসলিম বাঙালির প্রতিক্রিয়া’ নামে দুটো বই কলকাতার ‘খড়ি’ নামের এক সংস্থা থেকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। বই বের হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই বাংলাদেশের ‘আকাশ’ নামের এক প্রকাশন সংস্থা কপিরাইট আইনের তোয়াক্কা না করে দুটো বইই ছেপে নিয়েছে, লেখক, প্রকাশক কারোর অনুমতি না নিয়েই। খুঁজলে এমন নিদর্শন অনেক পাওয়া যাবে এ বঙ্গের বইবাজারেও। এ ক্ষেত্রে বইয়ের লেখক হিসেবে সৌম্য বসুর নামটা উল্লেখ করলেও, সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষের কপালে সেটাও জোটেনি। কয়েক বছর আগে প্রয়াত গৌরকিশোর ঘোষের লেখা একটা বিখ্যাত উপন্যাস সমরেশ মজুমদারের নাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল! এর কারণ হল, সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয় তাই তাঁর নাম ব্যবহার করে আরেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকের উপন্যাস বেমালুম ছেপে দেওয়া হয়েছিল। বইমেলার স্টল থেকে বই চুরি করা তেমন অপরাধ বলে হয়ত গণ্য করা হয় না কিন্তু একজনের লেখা বই বিনা অনুমতিতে অন্যজনের নামে প্রকাশ করে ব্যবসা করার মতো ফৌজদারি অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে বহু ‘বই-চোর’!