এক সময়ে ভোরে ট্রামের ঘন্টিতে ঘুম ভাঙত কলকাতার (Kolkata)। ভোর সওয়া চারটেয় পথে নামত ট্রাম (Tram)। কালীঘাট (Kalighat), খিদিরপুর, বিধান সরণি, শ্যামবাজারের প্রবীণ নাগরিকেরা আজও সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। কলকাতায় পথে নামার সার্ধশতবর্ষে পরিবেশবান্ধব সেই ট্রামই ‘শ্লথ গতির যান’ তকমা নিয়ে চিরদিনের জন্য শহর ছাড়ছে। পরিবহণ দপ্তর ও কলকাতা পুলিশ ইতিমধ্যেই শহরের দুঘর্টনা কমাতে চারটি বাদে সব ট্রাম-পথ পিচ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা-ও এই চারটি রুটে ট্রাম চলবে স্রেফ স্মারক হিসেবে। মেট্রো রেলের কাজের জন্য বিবাদী বাগ-কেন্দ্রিক সব ট্রাম রুট (Tram Route) বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, কাজ শেষ হলে আবার ট্রাম চলবে। শিয়ালদহ ও বেলগাছিয়া ফ্লাইওভারের স্বাস্থ্যের কারণে ট্রাম বন্ধ করার সময়েও সেই প্রতিশ্রুতি ছিল। আর এখন? পুলিশ প্রশাসন বলেই দিচ্ছে, এই শহর ট্রাম চলাচলের অনুপযুক্ত। পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর কথায়,’ট্রাম শহরে যানজটের কারণ বলে পুলিশ মনে করে। অব্যবহৃত ট্রামলাইন শহরের পথদুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ক’দিন আগেই বেলগাছিয়ায় ট্রামের ট্রাকে বাইক নিয়ে পড়ে এক পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রাম-পথ পিচ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।’
মেট্রো যে ভাবে মহানগরে ডালপালা মেলছে, তাতে কি ট্রামের স্মৃতিটুকুও আর থাকবে এই শহরের বুকে? পরিবহণমন্ত্রীর কথায়, ‘কলকাতার স্মারক হিসেবে চারটি রুটে ট্রাম চালাব। বর্তমানে ধর্মতলা-গড়িয়াহাট এবং বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জ রুটে ট্রাম চলছে। আরও দু’টি নতুন রুট যুক্ত হবে- ধর্মতলা-খিদিরপুর এবং ধর্মতলা-শ্যামবাজার।’ এর মধ্যে ধর্মতলা-খিদিরপুর রুটটি হেরিটেজ রুট। এখান দিয়েই ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ কলকাতায় প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রাম পরিষেবার সূচনা হয়। গড়ের মাঠের উপর দিয়ে এই রুটে ট্রামে ঘোরা ছিল এক আলাদা রোম্যান্টিসিজ়ম। সুখবরও কিছু আছে। বিদেশি পর্যটকদের কাছে কলকাতাকে আকর্ষণীয় করতে ধর্মতলা থেকে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত ট্রাম চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভিক্টোরিয়ার সামনে তৈরি হচ্ছে ট্রামের জন্য ট্যুরিস্ট প্ল্যাটফর্ম। এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে অর্থ দপ্তর। পরে খিদিরপুর পর্যন্ত এই ট্রাম যাবে। কিন্তু সেটা কবে? নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই। উম্পুনে এই রুটে ট্রামের সমস্ত ওভারহেড লাইন ছিঁড়ে গিয়েছিল। তার কিনতে টেন্ডার ডাকা হলেও, একটির বেশি সংস্থা অংশ নিচ্ছে না।
কলকাতাই হলো এশিয়ার একমাত্র শহর যেখানে এখনও টিমটিম করে ট্রাম চলে। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ৩.৯ কিলোমিটার পথে শহরে ট্রামের চাকা গড়িয়েছিল প্রথমবার। সে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। যদিও বেশি দিন চলেনি। তবে ফিরে এসেছিল নতুন ভাবে, নতুন মহিমায়। সবই চিরতরে চলে যাচ্ছে চার ইতিহাসের ধূসর পাতায়। তবে পরিবহণমন্ত্রীর আশ্বাস, ভবিষ্যতে কলকাতা ট্রাম চলার উপযুক্ত হলে তখন পিচ তুলে আবার ওই লাইন তুলে আনা হবে। তবে সেটা আদৌ বাস্তবসম্মত কি না, সে প্রশ্ন তুলেছে কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন। পুলিশ-প্রশাসনের যুক্তি খারিজ করে সংগঠনের সভাপতি দেবাশিস ভট্টাচার্যর বক্তব্য, ‘অসত্য তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন শহর পরিবেশবান্ধব এই যানকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে। ট্রাম চালাতে খরচও কম। সেখানে আমাদের ট্রাম চালানোর পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও তা নষ্ট করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে!’