শীতজুড়ে আর বসন্তের গোড়ায় ফি বছরই হামলা চালায় অ্যাডিনোভাইরাস। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাপাদাপি দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালে। প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছিল শ্বাসনালীর সংক্রমণের জন্যে দায়ী ওই জীবাণু। কিন্তু চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা, চলতি মরসুমে অ্যাডিনোভাইরাসের তাণ্ডব ২০১৮-কেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
আচমকা এমন থাবা চওড়া করার পিছনে দূষণ এবং করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
* ভিলেন কারা?
# নাইসেডের রিপোর্ট, বাংলায় এখন সর্দি-কাশি-জ্বর-শ্বাসকষ্টের নেপথ্যে সার্বিক ভাবে অ্যাডিনোভাইরাসের দাপট দেখা যাচ্ছে ৩২% রোগীর ক্ষেত্রে। এর পরেই রয়েছে রাইনোভাইরাসের (২০%) হামলা।
# চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা, শিশুদের মধ্যে, বিশেষত ২ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তাদের ৮০%-র ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অ্যাডিনোভাইরাসেরই ছোবল।
# শহরের পেডিয়াট্রিক ইনটেন্সিভিস্টরা বলছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে এর সঙ্গে মিশে থাকছে ফ্লু ভাইরাস, নোরোভাইরাস, এমনকী আরএসভি-র (রেসপিরেটরি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস) মিশ্র সংক্রমণ।
* নেপথ্যে কি চরিত্র বদল?
# মিউটেশনে যে অ্যাডিনোভাইরাস তার চরিত্র বদলে ফেলেছে, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
# নাইসেডের অধিকর্তা শান্তা দত্ত বলেন, ‘জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের রিপোর্টে অ্যাডিনোভাইরাসের চরিত্র-বদলের কোনও প্রমাণ মেলেনি। যে প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে, সেটি পুরনো।’
# ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে পাঠানো নমুনায় দেখা গিয়েছে এমনটা। সেখানে ৩২% নমুনায় মিলেছে অ্যাডিনোভাইরাস। তবে নতুন কোনও প্রজাতির নয়।
# নাইসেড সূত্রে খবর, অ্যাডিনোভাইরাসের ৪০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দেখা গিয়েছে, অনেকগুলি নমুনাতেই মিশে ভাইরাসের দু’টি স্ট্রেন-অ্যাডিনো-৩ এবং অ্যাডিনো-৭।
* তা হলে অ্যাডিনোর কেন এত দাপট?
# চিকিৎসকরা বলছেন, এর নেপথ্যে থাকতে পারে তিনটি কারণ। করোনার প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ প্রভাবে শিশুদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
# প্রথম কারণ, করোনাকালের প্রায় দু’বছরের ‘ইমিউনিটি গ্যাপ’ যার জেরে দুর্বল হয়ে গিয়েছে শিশুদের রক্ষণ। দ্বিতীয়ত, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছারখার করেছে ইনেট ইমিউনিটি বা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা। এবং তৃতীয় কারণ, দূষণের বাড়বাড়ন্ত।
* ইমিউনিটি গ্যাপ
# শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ তথা পেডিয়াট্রিক ইন্টেন্সিভিস্ট প্রভাসপ্রসূন গিরি বলেন, ‘করোনার সময়ে বাচ্চারা স্কুলে বেরোয়নি, টানা দু’বছর প্রায় বাড়িতেই বদ্ধ থেকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করেছে। এতে বাইরের নানা রোগজীবাণুর সঙ্গে লড়াইয়ে যে ক্ষমতা তাদের অর্জন করার কথা ছিল, তা হয়নি।’ এটাই ইমিউনিটি গ্যাপ।
#বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই ইমিউনিটি গ্যাপকেই চলতি মরসুমে অ্যাডিনোভাইরাসের দৌরাত্ম্যের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন।
* ছারখার ইনেট ইমিউনিটি
* চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, কোনও সংক্রমণের কবলে পড়লে শরীর যে ইমিউনিটি পায়, তাকে বলে অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনিটি বা অর্জিত রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা। আর যে ইমিউনিটি জন্মগত, তাকে বলে ইনেট ইমিউনিটি।
# প্রবীণ প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ প্রণবকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের অনেকেরই ধারণা, এই ইনেট ইমিউনিটিকে করোনা তছনছ করে দিয়েছে। ফলে অ্যাডিনোভাইরাসের দেদার সংক্রমণের সামনে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতেই দেরি করে ফেলছে ইমিউনিটি। ফলে দ্রুত শিশুরোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে।’
* দূষণের ছোবল
# ফুসফুস রোগ-বিশেষজ্ঞ আলোকগোপাল ঘোষালের বক্তব্য, দূষণ ভয়ঙ্কর বেড়েছে। যেটা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তা হল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাসমান ধূলিকণা। যা ভাইরাসকে মাটিতে থিতিয়ে যেতে দেয় না সহজে, বরং দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে।
# এর ফলে সংক্রমণ ছড়ায় অনেক দ্রুত। আবার দূষণের কোপে বেড়ে যায় অ্যালার্জিও। এর জেরেও ভাইরাসের সংক্রমণ চট করে হামলা চালায়।