শুক্রবার ২৪ ফেব্রুয়ারি। ঠিক দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৩ সালের এই দিন থেকেই কলকাতার (Kolkata) শহরে চলেছিল ভারতের প্রথম ট্রামগাড়ি (Tram In Kolkata)। অবশ্য একটা কথা জেনে রাখা দরকার যে সেই ট্রাম কিন্তু, যাত্রী পরিবহের জন্য ছিল না, ছিল পণ্য পরিবহণের জন্য। কিন্তু, লোকসান ও অন্যান্য কারণে শুরু হওয়ার মাত্র ন’মাসের মধ্যে সেই পণ্য-পরিবাহী ট্রাম বন্ধ করে দিতে হয়।
বর্তমানে কলকাতার যে সামান্য কয়েকটা রাস্তায় যাত্রীবাহী ট্রামগাড়ি চলে, সেই ট্রামের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল ১৮৮০ সালের ১ নভেম্বর তারিখ থেকে। তখনকার দিনে ট্রেনে যাত্রীর পাশাপাশি মালপত্রও নিয়ে যাওয়া হত অনেক। কিন্তু, হাওড়া ও শিয়ালদহে ট্রেনে যে মালপত্র আসত, সেগুলো দেশের অন্যান্য জায়গায় পাঠানোর জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে আসা জিনিসপত্র ট্রামপথে আর্মেনিয়ান ঘাট অবধি নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে কাঠের সেতু পার হয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেনে করে সেই সব জিনিসপত্র দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল।
পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রামের লাইন তৈরি হল। ভারতে প্রথম পণ্যবাহী ঘোড়ায়টানা ট্রাম চললো শিয়ালদা থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট অবধি। পরে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় এবং হাওড়ায় ট্রাম চলাচল আরম্ভ হয়। কিন্তু, প্রথম দিন থেকেই সেই ট্রামে জিনিসপত্রের বদলে সাধারণ মানুষই উঠতো বেশি। প্রথম যুগে ছিল ঘোড়ায়টানা ট্রাম। ঘোড়াকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় আস্তানা করা ছিল, আর ছিল ঘোড়ার জল খাওয়ার গামলা। কিছুকাল আগেও পুরনো কলকাতার অনেক রাস্তায় সেই গামলা দেখা যেত। জনাকীর্ণ পথে ট্রামের ঘোড়া মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যেত। ফলে তাদের উলটো পালটা দৌড়াদৌড়িতে গাড়ি লাইনচ্যূত হবার মতো ঘটনাও ঘটে যেত মাঝে মাঝে।
তারপর অল্প কিছুদিন স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালানো হলেও ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ থেকে খিদিরপুর ট্রাম লাইনে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চালানো আরম্ভ হয়। পরে কলকাতার সব ট্রামই বিদ্যুৎচালিত হয়ে যায়। কিন্তু, ক্যালকাটা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কপোর্রেশনের পক্ষে অত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না বলে ট্রাম কোম্পানি নোনাপুকুর ট্রামডিপোয় একটি বিদ্যুৎ বা বিজলি উৎপাদন জেনারেটর বসাল। ট্রাম কোম্পানির সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে কলকাতা কপোর্রেশন নোনাপুকুর ট্রামডিপোর পাশের নোনাপুকুর রোডকে বিজলি রোড নামে চিহ্নিত করে।
একটা সময়ে সারা কলকাতা জুড়ে প্রায় ৪৯ মাইল বা তার বেশি ট্রামপথ ছিল। এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। তার পর হয়ত একদিন সারা দেশের কোথাও আর ট্রামপথ থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার কমলাকে আর কোনও দিনও তার ভাইকে নিয়ে সামনের সিটে বসে কলেজে যেতে দেখবে না কমলার নীরব প্রেমিক। ট্রামের ধাক্কায় মৃত্যু বরণ করা কবি জীবনানন্দ দাশ ‘একটি নক্ষত্র আসে’ কবিতায় রাতের কলকাতার বর্ণনায় লিখছেন, “শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন/ জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;/ চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়…।” শুধু রাতের নয়, কলকাতার ‘শেষ ট্রাম’ও বোধ হয় এবার মুছে যেতে চলেছে এই শহরের বুক থেকে।