কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের ধান্যকুড়িয়ার কাশ্মীর মণ্ডল তো আর অত পরিণত কেউ নয়। সে মাত্র ১৬ বছরের। ছাত্র হিসেবে কাশ্মীর শনিবার তার সঙ্কল্প রক্ষা করল ঠিকই। কিন্তু মাধ্যমিকের ভূগোল পরীক্ষা দিল সে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা পাঁচ-সাড়ে পাঁচ আগে, সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ বাড়িতে খবর পৌঁছল, কাশ্মীরের বাবা সুরয মণ্ডল (৪৩) আর নেই।
পড়শি রাজ্য ওডিশার কটকের কাছে জাজপুরে এক ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সুরয যে ট্রাক চালাচ্ছিলেন, সেই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় উল্টো দিক থেকে আসা অন্য একটি ট্রাকের। সুরয এবং ট্রাকে থাকা ধান্যকুড়িয়ারই ছ’জন শ্রমিকের সবাই শেষ। ওই খবর যখন ধান্যকুড়িয়া বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন গলিতে ছোট, একতলা বাড়িটায় এসে পৌঁছল, কাশ্মীর তখন ভূগোলের বই-খাতায় ডুবে।
প্রথম কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়, তার পরেই কান্না আর কান্না কাশ্মীরের। পড়া আর হলো না। কাশ্মীর ঠিক করেছিল, এ দিন পরীক্ষা দিতেই যাবে না। কিন্তু কয়েক জন প্রতিবেশী, শাসক দলের দলের কয়েক জন নেতা বুঝিয়েসুজিয়ে গাড়িতে করে ধান্যকুড়িয়া হাইস্কুলের ওই ছাত্রকে নিয়ে যান পাঁচ-ছ’কিলোমিটার দূরে বুনোরাটি হাইস্কুলে।
এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ ধান্যকুড়িয়া বাসস্ট্যান্ট সংলগ্ন ওই তল্লাটে যখন পৌঁছনো গেল, ওই নাবালককে নিয়ে ততক্ষণে প্রতিবেশীরা পরীক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছেন। পড়শিরা জানালেন, স্ত্রী নেফুরা বিবি, ছেলে কাশ্মীর ও মেয়ে জ্যোতি খাতুনকে নিয়ে ছোট্ট সংসার ছিল সুরযের। জ্যোতি একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।
বাসিন্দা মদন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘সুরযের অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। ট্রাক চালিয়ে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাই ওদের পড়াচ্ছিলেন সুরয। উনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে।’ মৃতের স্ত্রী নেফুরা বিবি বলছিলেন, ‘শুক্রবার রাতে ট্রাক নিয়ে ওডিশায় রওনা হন আমার স্বামী। ওঁর গাড়িতে ওডিশা থেকে মুরগি আসত।
কথা ছিল, সোমবার ফিরবেন। শনিবার সকালে ছেলে তখন পড়ছে। এক প্রতিবেশী এসে খবর দিলেন, ওঁর ট্রাক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কেউ বেঁচে নেই।’ চোখ মুছতে মুছতে নেফুরা বিবি বলেন, ‘ছেলে পরীক্ষা দিতে রাজিই হচ্ছিল না। প্রতিবেশীরা কোনও রকমে ওকে বুঝিয়েসুজিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’
স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন পরীক্ষা দিতে দিতে হল-এ মাঝেমধ্যেই কেঁদে ফেলেছে কাশ্মীর। বিকেলে বাড়ি ফিরে কাশ্মীর ‘পরীক্ষা ভালো হয়েছে’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে কাশ্মীরের একটাই প্রশ্ন, ‘এ বার আমাদের কী হবে?’