‘রবীন্দ্র সেতু’, ‘শহিদ মিনার’ বা ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল’-এর মতো হলুদ-ট্যাক্সিও যে শহর কলকাতার ঐতিহ্যবাহী (Heritage Of Kolkata) চিহ্ন বহন করে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু, এ বার বোধ হয় সেই ঐতিহ্যের কিছু হানি হতে চলেছে। খবরে প্রকাশ, পরিবেশ দূষণের কারণে আগামী দু’বছরের মধ্যে কলকাতা ও শহরতলীতে চলমান হলুদ-ট্যাক্সির (Kolkata Yellow Taxi) একটা বড় অংশই ব্যবহারের অযোগ্য বলে পরিত্যক্ত হবে।
ভারতের শীর্ষ আদালত বেশ কিছু বছর আগেই মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া পেট্রল-ডিজেল চালিত যানবাহনের চলাচলের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই নির্দেশ অনুসারে সারা দেশের বিপুল সংখ্যক যানবাহনের পুরনো ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হয়েছিল বা সেই সব গাড়ি বাতিল করতে হয়েছিল। শহর কলকাতায় এখন যে হলুদ-ট্যাক্সি চলাচল করে সেগুলোর প্রায় সবই হিন্দুস্থান মোটর কোম্পানির তৈরি ‘অ্যাম্বাসাডার’ গাড়ি। ওই কোম্পানি আর ‘অ্যাম্বাসাডার’ গাড়ি তৈরি করে না, আগেকার তৈরি সব গাড়ির ইঞ্জিনই আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ কর ফেলবে।
স্থলপথে ভারতের প্রাচীনতম যানগুলোর মধ্যে গোরুরগাড়ি ছাড়াও জনপ্রিয় ছিল ডুলি ও পালকি। কলকাতার শহরে মালপত্র বহনের জন্য গরুরগাড়ি ব্যবহৃত হলেও জনপরিবহনের জন্য ডুলি-পালকিই ছিল সেরা যান তবে সেগুলোর খরচ এত বেশি ছিল যে, সাধারণ মানুষ তা ব্যবহার করতে পারতো না। পাশাপাশি ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও অভিজাতদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি চললেও তা জনপ্রিয় হয় ১৮২৭ সালে কলকাতার ওড়িয়া পালকি-বাহকদের ধর্মঘটের সময় থেকে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। গণপরবিবহন হলেও ব্যববহুল বলে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল বিত্তশালীদের মধ্যেই।
আমজনতার আর্থিক সামর্থের মধ্যে প্রথম গণপরিবহন ছিল ট্রাম। ১৮৭৩-এ পণ্য পরিবহনের জন্য এবং ১৮৮০ সাল থেকে যাত্রী পরিবহনের জন্য যে ট্রামগাড়ি চলা আরম্ভ হয়েছি, সংখ্যায় কমে গেলেও এখনও তা চলছে। কলকাতার শহরে ঘোড়ায়টানা বাস প্রথম ১৮৩০ সালে চললেও, তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। গণপরিবহন হিসেবে যাত্রীবাহী মোটর-বাস চালু হয় ১৯২২ সালে।
আবার ট্যাক্সির কথায় ফিরে আসা যাক। কলকাতার শহরে প্রথম মোটরগাড়ি চলেছিল ১৮৯৬ সালে আর ভাড়ার গাড়ি হিসেবে তা চলতে আরম্ভ করে ১৯০৬ সাল থেকে। চৌরঙ্গি রোডের উপর সাবেক ‘ফ্রেঞ্চ মোটরকার’ কোম্পানির অফিসের কাছ থেকে ভাড়ার মিটার দেওয়া ‘ওভারল্যান্ড’ মডেলের মোটরগাড়ি ট্যাক্সি ভাড়ায় পাওয়া যেত। সে সব গাড়ির রং তখন হলুদ ছিল না। অনেক পরে, অন্য গাড়ির সঙ্গে তফাৎ বোঝানোর জন্য ট্যাক্সির গায়ের রং হল কালো আর মাথাটা হলুদ। সে গাড়ি শুধু কলকাতার সীমানার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করতে পারতো। আরও পরে ট্যাক্সি চলাচলের সীমানা বাড়িয়ে সম্পূর্ণ হলুদ রঙের ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করে কলকাতার রাস্তায়। বেশ কিছুকাল আগে অবশ্য ‘নো রিফিউসাল’ লেখা পুরো সাদা রঙের ট্যাক্সিও কলকাতায় চলতে আরম্ভ করে।
আদালত এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ অনুসারে যে সমস্ত ট্যাক্সির আয়ু আর মাত্র কয়েক বছর, সেগুলো বেশির ভাগই ‘অ্যাম্বাসাডার’ গাড়ি। ওই বিপুল সংখ্যক গাড়ি বাতিল হয়ে গেলে কলকাতার যানবাহন চলাচলে বড় শূন্যতা দেখা দেবে। সম্প্রতি ব্রিটেন এবং ভারত সরকারের উদ্যোগে ‘অ্যাক্সিলারেটিং স্মার্ট পাওয়ার অ্যান্ড রিনিউয়েবেল এনার্জি ইন ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামের অধীনে কলকাতায় আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে ওই শূন্যতা পূরণ করতে ডিজেল-চালিত গাড়ির ইঞ্জিন পালটে ইলেক্ট্রনিক ভেহিকল বা ইভি ইঞ্জিন বসানোর প্রস্তাব এসেছে। ওই ইঞ্জিন রিচার্য করা যায় এমন ব্যাটারিতে চলে। খবরে প্রকাশ, বেঙ্গল ট্যাক্সি ইউনিয়ন-সহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, গাড়িগুলোকে ডিজেল থেকে ইভি ইঞ্জিনে পরিবর্তন করতে যে বিপুল খরচ হবে তা কতজন ট্যাক্সি-মালিক বহন করতে পারবেন, সেটা নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু এই পদ্ধতিতে গাড়ি চালানোয় কিছু সমস্যা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, ভারতে ইভি ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ি চলাচল আরম্ভ হলেও ব্যাটারি রিচার্জ করাবার স্টেশনের সংখ্যা খুবই কম। ফলে মাঝপথে চার্জ ফুরিয়ে গেলে যাত্রীরা সমস্যায় পড়তে পারে। পরিবর্ত হিসেবে ডিজেল ইঞ্জিন চালিত গাড়িগুলোকে সৌরশক্তি চালিত ব্যাটারির গাড়িতে রূপান্তরিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। গত এক দশকে সৌরশক্তি চালিত উন্নত মানের গাড়ি বাজারে এসেছে। প্রশাসন, ট্যাক্সি ইউনিয়ন এবং ট্যাক্সি-মালিকেরা বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন।