লালগড় আন্দোলনের উত্তাল ও অগ্নিগর্ভ সময় থেকে চর্চায় ধরমপুর নামটা। মাওবাদীদের নেতৃত্বে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে লালগড়ের ধরমপুর গ্রামে সিপিএমের তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুজ পাণ্ডের শৌখিন দোতলা বাড়ি ধ্বংস হওয়া, ধ্বংসলীলা চলাকালীন সাংবাদিকদের সঙ্গে কাঁধে অটোম্যাটিক রাইফেল নিয়ে মাওবাদী নেতা বিকাশের কথা বলার মতো ঘটনা পরম্পরার কারণে ধরমপুর স্মরণীয়।
কিন্তু লালগড় থানা এলাকায় একটা নয়, মোট তিন-তিনটে ধরমপুর। আর এই ধরমপুর নামের ধাঁধার কারণেই মোস্ট ওয়ান্টেড এক মাওবাদী সম্প্রতি পুলিশের এক রকম হাত ফস্কে গেলেন বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। ওই মাওবাদী নেতার হদিশ পেতে কয়েক লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ।
রাজ্য পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই মাওবাদী নেতার নাম সব্যসাচী গোস্বামী ওরফে কিশোরদা ওরফে পঙ্কজ। এনআইএ-র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ লিস্টে রয়েথে উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলা এলাকার সোদপুর রোডের সব্যসাচীর নাম। এনআইএ-র বক্তব্য, দক্ষিণবঙ্গের দায়িত্বে থাকা, মাওবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী গুয়াহাটিতে গত বছর মার্চের মাঝামাঝি রুজু হওয়া তাদের একটি মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত। মামলাটি অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতে মাওবাদীদের সংগঠন বিস্তার সম্পর্কিত।
আবার কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) গত বছর মার্চের শেষ দিকে নদিয়ার জাগুলিয়া থেকে সন্দেহভাজন মাওবাদী নেত্রী হিসেবে জয়িতা দাসকে গ্রেপ্তার করে। তখন জানা যায়, মুর্শিদাবাদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় মাওবাদীরা সংগঠন তৈরি করছিল। এসটিএফের দাবি, মুর্শিদাবাদের ওই মাওবাদী কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সব্যসাচী। সেই জন্য সব্যসাচীকে খুঁজছে এসটিএফ-ও।
সম্প্রতি পুলিশ খবর পায়, লালগড় থানা এলাকার ধরমপুর গ্রামে মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী গোপন মিটিং করছেন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুলিশ সূত্রের খবর, কিছুক্ষণের মধ্যেই চিরুনি তল্লাশি চালানো শুরু হয় ধরমপুর গ্রামে, যেখানে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের বাড়ি। অচিরেই বোঝা যায়, সেখানে মাওবাদীদের কোনও বৈঠক হচ্ছে না।
এর পর পুলিশ পৌঁছয় সিজুয়া তথা কাঁটাপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ধরমপুর গ্রামে- যা স্থানীয়দের অনেকের কাছে পরিচিত লকাট-ধরমপুর নামে। কিন্তু সেখানেও ছানবিন করে কিছুই মেলেনি। পরে পুলিশের উপলব্ধি হয়, একে পিচরাস্তার প্রায় উপরে থাকা গ্রাম, তার উপর সেখানে মাওবাদীদের এক সময়ের সঙ্গী বা ঘনিষ্ঠরা প্রায় সবাই এখন রাজ্যের শাসক দলের সক্রিয় কর্মী-সমর্থক- সেখানে সব্যসাচী কী ভাবে মিটিং করতে পারেন? অথচ গোয়েন্দা-তথ্য নিশ্চিত ভাবে বলছে, লালগড় থানা এলাকার ধরমপুর গ্রামেই সব্যসাচী মিটিং করছেন।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পর ধাঁধার সমাধান হয়। ততক্ষণে স্বভাবতই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সব ভোঁ-ভাঁ।
কিন্তু ধাঁধাটা কী?
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, রামগড় গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় রয়েছে ধরমপুর মৌজা। তবে সেখানে কোনও জনবসতি নেই, আছে কেবল অল্প পরিমাণ চাষের জমি আর ঘন জঙ্গল। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, সব্যসাচী ওরফে কিশোরদা মিটিং করে গিয়েছেন ওই ধরমপুরে। অনুজ পাণ্ডে-খ্যাত ধরমপুর থেকে লালগড় হয়ে ওই ধরমপুরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। রামগড়ের ওই ধরমপুরে লালগড় আন্দোলনেরও আগে ডেরা ছিল মাওবাদী নেতা-নেত্রী শশধর, সুচিত্রা, বিকাশ, আকাশদের। ওই ধরমপুর থেকে মোরাম রাস্তা-জঙ্গলপথে বাঁকুড়ার সারেঙ্গার খয়েরপাহাড়ি গ্রামের দূরত্ব মেরেকেটে ৫ কিলোমিটার। মিটিং সেরে সব্যসাচী ওই রাস্তা ধরেই গিয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ।
কিন্তু মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী গোস্বামী কেন খাস লালগড়ে এসে ঘণ্টা চারেক মিটিং করে গেলেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে মাওবাদীরা নাশকতার ছক কষছে কি না, কারা ওই বৈঠকে ছিলেন- পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসাররা আপাতত এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।