মেডিক্যাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ রায় নাবালিকার গর্ভপাতের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে আদালতের নির্দেশ, যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যদি দেখা যায় নাবালিকা বা তার পরিবার সন্তান পালনে অক্ষম এবং ওই দুই শিশুসন্তানকে দত্তক নেওয়ার জন্য কেউ আগ্রহী নয়, তা হলে নাবালিকা ও তার পরিবার সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে পারবেন শিশু দু’টির লালনপালনের জন্যে।
গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ২০১৯-য়ে সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদকে হাতিয়ার করে ৩৯ বছরের এক যুবতীর আবেদনের শুনানি হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ সেই সময়ে মন্তব্য করেছিল, ‘এ ক্ষেত্রে জীবনের অধিকার মানে নিছক জৈবিক অস্তিত্ব নয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছু।’ ওই মামলাতেও আদালত মেডিক্যাল রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছিল। কিন্তু ওই যুবতীর মেডিক্যাল রিপোর্টে স্পষ্ট ছিল, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হবে। তাই আদালত সে ক্ষেত্রে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়।
এ ক্ষেত্রে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা বছর বারোর নাবালিকা ও তার গর্ভস্থ যমজ ভ্রূণের শারীরিক অবস্থা জানতে মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ চেয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ। মেডিক্যাল বোর্ড জানায়, ২৫ সপ্তাহের যমজ ভ্রূণের কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু নাবালিকার বয়স যেহেতু মাত্র ১২ বছর, তাই এই অবস্থায় গর্ভপাতের ক্ষেত্রে প্রবল রক্তপাত, সংক্রমণ, সেপসিস এবং সার্জারি সংক্রান্ত ঝুঁকি থেকে যায়। এমনকী মৃত্যুর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাই নাবালিকার আর্জির শুনানির সময়ে বিচারপতি মনে করেছেন, এই পরিস্থিতিতে মেয়েটির জীবন রক্ষাই আদালতের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের বক্তব্য, ‘যদি এই অ্যাডভান্সড স্টেজে গর্ভপাত করাতে গিয়ে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নাবালিকার জীবনহানি হয়ে যায়, তা হলে সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে যে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্ভ্রমের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে–তা কী ভাবে রক্ষিত হবে, এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়। তা বিবেচনা করেই আদালত নাবালিকার গর্ভপাতের অনুমতি দিতে পারছে না।’
এ বছরের ৯ মার্চ ওই নাবালিকাকে ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের অভিযোগে মামলা রুজু হয় বাগডোগরা থানায়। যদিও তার অনেক আগেই ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ওই নাবালিকা। পুলিশে অভিযোগ দায়েয়ের পর নাবালিকাকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখনই জানা যায়, ২৫ সপ্তাহের যমজ ভ্রূণ রয়েছে তার গর্ভে।
এর পর গর্ভপাতের আর্জি জানিয়ে নাবালিকার মা সার্কিট বেঞ্চের দ্বারস্থ হন। আদালতের কাছে বিচার্য ছিল, এই অনিচ্ছুক মাতৃত্ব নাবালিকার মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করবে কিনা। শুধুমাত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মায়ের বাকি জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে যাতে ঠেলে না-দেওয়া হয়, তাও বিবেচনা করেছে আদালত। তবে মেডিক্যাল রিপোর্ট গর্ভপাত করাতে গিয়ে নাবালিকার জীবন সংশয়ের আশঙ্কার কথা বলায় আদালত মেয়েটির প্রাণরক্ষাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ ছিল, এখন থেকে যে কোনও মহিলার (বিবাহিত বা অবিবাহিত) সর্বোচ্চ ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রে আইনত কোনও বাধা নেই। তার আগে পর্যন্ত বিবাহিতদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ওই সময়সীমা চালু থাকলেও অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে তা ছিল ২০ সপ্তাহ। গর্ভপাত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সারা পৃথিবী জুড়েই। এক সময়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতকে সে দেশের মেয়েদের সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু গত বছর জুন মাসে সেই অধিকার প্রত্যাহার করে নেয় সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট।