এ চিকিৎসার নাম ইমিউনোথেরাপি। এতে ক্যান্সার আক্রান্ত শরীরের নিজস্ব ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বাড়িয়ে তুলে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলিকে নিকেষ করা হয়। অনেক রকম ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসা বলে ইমিউনোথেরাপি এখন স্বীকৃত সারা দুনিয়ায়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হলো অ্যান্টি-পিডি১ থেরাপি যা ২০১৮ সালে জিতে নিয়েছিল নোবেল পুরস্কার।
কিন্তু অত্যন্ত মহার্ঘ এই চিকিৎসা সকলের ক্ষেত্রে কাজ করে না। ফলে অনেকের ক্ষেত্রেই নষ্ট হয় অর্থ ও বহুমূল্য সময়। কার শরীরে এই থেরাপি কাজ করবে আর কার শরীরে কাজ করবে না, সেই পথটাই এবার চিনিয়ে দিল কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা।চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের (সিএনসিআই) একদল গবেষক আবিষ্কার করলেন এমন একটি উপায়, যার দ্বারা সহজেই বোঝা যায়, সংশ্লিষ্ট ক্যান্সার আক্রান্তের শরীরে অ্যান্টি-পিডি১ ইমিউনোথেরাপি কাজ করবে কি না।
শুধু তা-ই নয়, যাঁদের শরীরে তা কাজ করবে না, তাঁদের ক্ষেত্রেও একটি বিকল্প চিকিৎসার রাস্তার হদিশ দিয়েছেন ওই গবেষকরা। তাঁদের সেই কাজ গবেষণাপত্রের আকারে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানপত্রিকা ‘ক্যান্সার রিসার্চ’ জার্নালে। এই গবেষণার কথা প্রকাশ্যে আসতেই তা বাহবা কুড়িয়ে নিয়েছে চিকিৎসক মহলে।
কেননা, গবেষকদের দেখানো পথ অনুসরণ করলে একদিকে যেমন বেশ কয়েক ধরনের ক্যান্সার থেকে নিশ্চিত নিরাময়ের আশা থাকে অনেকটা, তেমনই আবার বন্ধ হয় অর্থ ও সময়ের অপচয়।গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই অ্যান্টি-পিডি১ থেরাপি স্তন, গর্ভাশয়, জরায়ুমুখ, ফুসফুস, ত্বক, খাদ্যনালী, কিডনি ইত্যাদির ক্যান্সারকে শুধু প্রতিহতই করে না, নির্মূলও করে অনেকাংশে। প্রকল্পের মুখ্য গবেষক, সিএনসিআই-এর ইমিউনোরেগুলেশন ও ইমিউনোডায়গনস্টিক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান রথীন্দ্রনাথ বড়াল বলেন, ‘অ্যান্টি-পিডি১ থেরাপির মতো বহুমূল্য চিকিৎসা শুরু করার আগে আমাদের দেখানো পথে রোগীকে স্ক্রিনিং করে নেওয়াই ভালো।
যদি দেখা যায় রোগীর শরীরে টি-টেক্স নামের এক ধরনের ক্যান্সার-বান্ধব কোষের বাড়বাড়ন্ত রয়েছে, তখন অ্যান্টি-পিডি১ প্রয়োগ করেও লাভ হবে না। কেননা এই টি-টেক্স কোষগুলিই ইমিউনিটিকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়তে বাধা দেয়। ইমিউনোথেরাপির আগেই বিষয়টি বোঝা গেলে টাকা ও সময় নষ্ট হয় না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচে শরীরও।’কী হবে সেই সব রোগীর ক্ষেত্রে, যাঁদের উপর কাজ করবে না এই ইমিউনোথেরাপি? রথীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, তারও একটি সম্ভাব্য রাস্তার হদিশ মিলেছে তাঁদের এই গবেষণায়।
তাঁর ব্যাখ্যা, ‘যে সব ক্যান্সার রোগীর শরীরে টি-টেক্স কোষ বেশি থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ওই কোষগুলিই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। সেই কাজটি তারা করে ল্যাম্প-৩ এবং এনআরপি-১ নামে দু’টি রাসায়নিকের সাহায্যে। যদি এই দু’টি রাসায়নিককে টার্গেট করে ওষুধ বানানো যায়, তা হলেই খেলা শেষ টি-টেক্সের। তখন আর অসুবিধা হবে না তাঁদের চিকিৎসাতেও, যাঁদের উপর অ্যান্টি-পিডি১ থেরাপি কাজ করছে না।
‘গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই ল্যাম্প-৩ ও এনআরপি-১ প্রতিরোধক ওষুধ আবিষ্কার করাটাই তাঁদের গবেষণার পরবর্তী লক্ষ্য। তবেই তাঁদের কাজের ষোলকলা পূর্ণ হবে। গবেষক দলে ছিলেন সিএনসিআই-এর রিসার্চ স্কলার মোহনা চক্রবর্তী, অধুনা মোহালির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফার্মাসিউটিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অনামিকা বসু এবং লখনৌয়ের সেন্ট্রাল ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দীপক দত্ত। এই গবেষণা প্রকল্পটিতে আগাগোড়া উৎসাহ জুগিয়ে এসেছেন সিএনসিআই-এর অধিকর্তা জয়ন্ত চক্রবর্তী।
ক্যান্সার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়, রেডিয়োথেরাপি বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, ব্রেস্ট ক্যান্সার সার্জেন দীপ্তেন্দ্র সরকারের মতো বিশিষ্ট চিকিৎসকরা এই কাজকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তাঁদের মূল বক্তব্যের নির্যাস হলো, বেশ কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসায় আজকাল প্রথাগত কেমোথেরাপি কিংবা রেডিয়োথেরাপির চেয়েও ইমিউনোথেরাপিতে দারুণ কার্যকর ফল মেলে। কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে মেলে না প্রত্যাশিত সাফল্য। কাদের ক্ষেত্রে তা উপযোগী, সেই রাস্তাটা চিনিয়ে দেওয়াই এই গবেষণার সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক। এতে রোগী-পরিজন আর্থিক ভাবে লাভবান হবেন যেমন, তেমনই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আগেই বিকল্প চিকিৎসার চেষ্টা করা সম্ভব হবে চিকিৎসকের পক্ষে।