করোনা বাড়তেই টিকার বুস্টার ডোজ়ের পক্ষে সওয়াল করছেন অনেকে। বয়স্ক এবং কো-মর্বিডিটির শিকার যাঁরা, বুস্টার এড়ানো তাঁদের যে উচিত নয়, সে কথা বহু বিশেষজ্ঞই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশ এই প্রশ্নও তুলছেন যে, এই টিকায় কি আদৌ কোনও লাভ হবে, নাকি হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি? তাঁদের যুক্তি, করোনার যে সব ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট কালেদিনে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেগুলোর সামনে ওই টিকা এতই পুরোনো যে, তা এখন অচল। অধিকাংশ চিকিৎসকের দাবি, টিকা একান্তই নিতে হলে করোনার নতুন টিকা দরকার।
নতুন করোনা-টিকার পক্ষে সওয়াল করা চিকিৎসকদের যুক্তি, করোনার টিকা তৈরি হয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। তখনও নভেল করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই আত্মপ্রকাশ করেনি। তার পর ধীরে ধীরে প্রকট হয়েছে ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস, ওমিক্রন ও ডেল্টাক্রন এবং তারও পরে ওমিক্রনের একের পর এক-অন্তত আধ ডজন সাব-ভ্যারিয়েন্ট। এবং তাতে দেদার আক্রান্ত হয়েছেন দেশবাসী।
এখন আবার মাথাচাড়া দিয়েছে ওমিক্রনের দু’টি নতুন উপ-প্রজাতি- আর্কটুরাস ও ক্র্যাকেন। তাই, ওই চিকিৎসক তথা বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, পুরোনো সেই টিকার বুস্টার ডোজ় নিয়ে কী লাভ, যাকে সহজেই ফাঁকি দিচ্ছে ওমিক্রনের জাতভাইয়েরা? তাঁদের অভিমত হলো, টিকার পরিমার্জন জরুরি হয়ে উঠেছে এবং পরিমার্জিত হলে তবেই সে টিকা কার্যকর হবে, অন্যথায় নয়।
সম্প্রতি টিকার বুস্টার ডোজ় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেশজোড়া বিতর্ক তৈরি করেছেন দিল্লি এইমসের কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় রাই। তাঁর বক্তব্য, ‘করোনার টিকা যেহেতু বেশ পুরোনো, তাই তার বুস্টার ডোজ় একেবারেই সক্ষম নয় আর্কটুরাস বা ক্র্যাকেন সামলাতে। তা হলে জেনেশুনে লোকে কেন টিকা নেবে? লাভ নেই জেনেও কেন তারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি ডেকে আনবে পুরোনো টিকা নিয়ে?’ তাঁর সঙ্গে একদিকে ভিন্নমত, অন্য দিকে সহমত পোষণ করেছেন অনেকে।
মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ সৌগত ঘোষ বলেন, ‘টিকা পুরোনো ঠিকই। কিন্তু তার বুস্টার ডোজ় নিলে কিছুটা উপকার কম হলেও তো মিলবে। আক্রান্ত হলেও উপসর্গ গুরুতর হবে না।’ উল্টো দিকে, ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ জোয়ারদার মনে করছেন, ‘বছর খানেক আগে হলেও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই সব টিকার ভূমিকা ছিল।
পরে ক্রমাগত সংক্রমণ ও তার পাশাপাশি, অনেকের টিকা নেওয়ার কারণে দেশ জুড়ে মোটামুটি একটা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। এর পরে এখনও করোনার সংক্রমণ হচ্ছে মানে, নভেল করোনাভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে নিজের ভোল পাল্টাচ্ছে। তার থেকে আমাদের সহজাত ইমিউনিটি যদি সুরক্ষা না-দিতে পারে, তা হলে সে কাজ টিকাও পারবে না।’
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায়ের প্রশ্ন, ‘বর্তমানে অতি সাধারণ মৃদু উপসর্গ ছাড়া করোনায় যখন প্রায় কারও তেমন কোনও সমস্যা হচ্ছে না, তখন খামকা সবার টিকার দরকারই বা কী?’ তবে তাঁর পরামর্শ, ‘বয়স কিংবা কো-মর্বিডিটির কারণে যাঁদের ঝুঁকি রয়েছে, তাঁদের বুস্টার নিতেই হবে।’
আর এক ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ সৌরীশ ঘোষ মনে করেন, ‘সুস্থ মানুষের প্রায় সবাই এখন যখন করোনায় গুরুতর অসুস্থও হচ্ছে না, তখন ২০২০-তে তৈরি টিকার বুস্টার ডোজ় এই ২০২৩-এ এসে সবার নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। বরং, একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত যে, স্পাইক প্রোটিন নির্ভর ভ্যাকসিনগুলি আমাদের শরীরে অধিকাংশের ক্ষেত্রে লং কোভিডের উপসর্গ তৈরি করতে পারে।
তাই, টিকার পিছনে না-দৌড়ে এখন করোনাকে সাধারণ ফ্লু-এর মতো ভাবতে হবে।’ তবে সেই সঙ্গে তাঁর সতর্কতা, ‘যে কোনও সময়ে করোনার এমন কোনও সংক্রামক স্ট্রেন বা ভ্যারিয়েন্ট চলে আসতে পারে, যা মানুষকে বেশি মাত্রায় অসুস্থ করতে সক্ষম। সে দিকে বিজ্ঞানীদের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।’