পড়াশোনা-গবেষণা ছাড়াও আরও একটা বিষয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সেটা হল, ভারতের এই বিশ্ববিদ্যালয়তেই প্রথম তৈরি হয় এক সমৃদ্ধ প্রদর্শশালা বা মিউজিয়াম।
১৯৩৭ সালে, তৎকালীন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে গোটা পাঁচেক প্রত্নবস্তু নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এক মিউজিয়ামের। উপাচার্য থাকাকালীন শ্যামাপ্রসাদের বাবা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব, ভারতশিল্প-সহ ভারতবিদ্যার চর্চা আরম্ভ করেছিলেন, তাই তাঁর নামেই উৎসর্গ করে ‘আশুতোষ মিউজিয়ম অফ ইন্ডিয়ান আর্ট’ বা সংক্ষেপে ‘আশুতোষ মিউজিয়াম’ নাম দেওয়া হয় ওই প্রদর্শশালার। প্রথম কিউরেটর ছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ। শুধু সংগ্রহ নয়, নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননও আরম্ভ করে মিউজিয়াম। কিন্তু, প্রচারের অভাবে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গিয়েছে কলকাতার এই অন্যতম প্রত্ন-সংগ্রহশালা।
একেবারে গোড়ায় সাবেক ‘সেনেট হল’-এর এক কোণায় ছিল এই সংগ্রহশালা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ায়। যুদ্ধশেষে কলকাতায় ফিরে এলেও গত শতকের ষাটের দশকে সেনেট হল ভাঙবার সময়ে আবার ঠাঁইনাড়া হয়ে মিউজিয়াম চলে যায় ১৪ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে। ‘সেনেট হল’ ভেঙে নতুন শতবার্ষিকী ভবন তৈরি হবার পরে ১৯৬৭ সালে আবার কলেজ স্ট্রিট চত্বরেই ফিরে আসে প্রদর্শশালা।
বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে (অধুনা আশুতোষ শিক্ষাপ্রাঙ্গণ) শতবার্ষিকী ভবনের পিছন দিকে একতলা এবং দোতলা মিলিয়ে রয়েছে এই মিউজিয়াম।
ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহশালা হিসেবে খ্যাত প্রায় ছিয়াশি বছরের প্রাচীন এই সংগ্রহশালা ৩০ হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু, পাথর ও ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, মুদ্রা, বাংলার টেরাকোটা, চিত্রকলা, বস্ত্রশিল্প, কাঠখোদাই ও লোকায়ত শিল্পের নানাবিধ নিদর্শনে সমৃদ্ধ।
প্রতিষ্ঠার বছরেই সংগ্রহশালার পক্ষ থেকে দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে উৎখনন শুরু হয়। বাণগড় জায়গাটি ইতিহাসে কোটিবর্ষ, দেবীকোট প্রভৃতি নামেও চিহ্নিত। অবহেলিত প্রত্ন-ইতিহাস সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ। কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামীর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৩৮-১৯৪১ পর্যন্ত, বছর চারেক ধরে এই অঞ্চল খুঁড়ে মৌর্য যুগ (আনুমানিক ৩২৪ পূর্ব-সাধারণাব্দ) থেকে ইসলাম আমল অবধি সময়কালের প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে।
বঙ্গভূমির অন্যতম প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা অঞ্চলের চন্দ্রকেতুর গড় আর খনা-মিহিরের ঢিবির খননের কাজও এই মিউজিয়ামের উদ্যোগে হয়েছে। বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে থাকা ওই প্রত্নক্ষেত্র থেকে দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন রকমের প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছিল খবর পেয়ে ১৯৫৬ সালে আশুতোষ মিউজিয়ামের উদ্যোগে চন্দ্রকেতুর গড় অঞ্চলে প্রথম খননের কাজ হয়। তার পরে অবশ্য বেশ কয়েকবার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে অঞ্চলটা খোঁড়া হয়েছে। জানা গিয়েছে, প্রাচীন শুঙ্গ যুগ বা তার আগে থেকেই অঞ্চলটা সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। অনেকের মতে, ওই চন্দ্রকেতুর গড়ই প্রাচীন গঙ্গারিডি সভ্যতা।
এ ছাড়াও বীরভূমের নানুর-এ চণ্ডীদাস ঢিবি প্রভৃতি জায়গায় খননকার্য চালিয়ে পাওয়া বহু মূল্যবান প্রত্নবস্তু রয়েছে এখানে, যার মধ্যে টেরাকোটা ফলক, সিলমোহর, প্রাচীন মৃৎপাত্র, রৌপ্যমুদ্রা প্রভৃতি বস্তু উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছে পূর্ববঙ্গের রাজশাহি-র পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া প্রাচীন টেরাকোটার ফলক ইত্যাদি। মূর্তি বা টেরাকোটার ফলকের পাশাপাশি চিত্রিত পুথি ও পুথির পাটার এক ভাল সংগ্রহ রয়েছে এখানে। মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে পাওয়া চিত্রশোভিত ‘রামচরিতমানস’-এর পুথি-সহ আরও কিছু মূল্যবান নিদর্শন দেখা যাবে এখানে। শুধু বাংলা নয়, নেপাল এমনকী পশ্চিম ভারতের জৈন ধর্মালম্বীদের চিত্রিত পুথিও স্থান পেয়েছে প্রদর্শশালায়।
অত্যন্ত সমৃদ্ধ এখানকার লোকশিল্পের গ্যালারিও। গ্রামবাংলার দৈনন্দিন জীবনে নিত্যব্যবহার্য হাঁড়ি, সরা-সহ অন্যান্য তৈজসপত্র কিংবা কাঁথা, পুতুলের মতো আপাত তুচ্ছ জিনিসও যে প্রদর্শশালার দ্রষ্টব্যবস্তু হিসেবে স্থান পেতে পারে তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। বাংলার ঐতিহ্যশালী বস্ত্রশিল্পের অজস্র নমুনা স্থান পেয়েছে এখানে। দেখা যাবে মসলিন, ঢাকাই জামদানী, মুর্শিদাবাদী বালুচর, বিষ্ণুপুরী ময়ূরকণ্ঠীর মতো স্বনামখ্যাত সব কাপড়ের।