মোবাইলের ফোনবুক খুলে কি আপনি কার নাম সার্চ করতে চাইছেন, সেটাই মাথায় আসছে না মাঝেমধ্যে? মিটিংয়ে অত্যন্ত চেনা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনকেও কি মাঝেমাঝে খুবই অচেনা লাগছে? বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু শব্দ বা কথা হঠাৎ ভুলে যাচ্ছেন? কাজের প্ল্যানিং কি পরের দিন মনেই থাকছে না? কোনও বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে আচমকা খেই হারিয়ে ফেলছেন? আপনার যদি করোনা হয়ে থাকে, আর যদি এই সমস্যাগুলো থাকে, তা হলে জানবেন লং কোভিডের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গ ব্রেন ফগিংয়ে আপনি কাবু।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের উপসর্গ নিয়ে রোগী আসার যে চল শুরু হয়েছিল ২০২০-র শেষ দিকে, সেই ধারা এখনও জারি। কেন এমনটা হচ্ছে, সম্প্রতি সে বিষয়ে গভীর ভাবে আলোকপাত করেছে একটি মার্কিন গবেষণা। তাতে স্পষ্ট, মস্তিষ্কের গঠনেই প্রভাব ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। কোভিডে বেশি অসুস্থ হয়েছিলেন না কম, ব্রেন ফগিংয়ের ক্ষেত্রে তার কোনও আলাদা প্রভাব নেই।
গবেষক দলের প্রধান, ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড স্কুল অফ মেডিসিনের রেডিয়ো-ডায়গনস্টিক্স এবং নিউক্লিয়ার মেডিসিনের অধ্যাপক লিন্ডা চ্যাং সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভুলে যাওয়া, বিভ্রান্তি, ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলা, চেনা জিনিসকে অচেনা লাগা, মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, উদ্বেগ, অবসাদের সমস্যায় ভোগা ২৯ জনের ফাংশনাল এমআরআই পরীক্ষা করে তাঁরা দেখেছেন, এঁদের মধ্যে যে ২১ জনের করোনার ইতিহাস আছে, তাঁদের মস্তিষ্কের গঠনগত কিছু স্নায়বিক পরিবর্তন অন্য ৮ জনের তুলনায় চোখে পড়ার মতো বেশি।
লিন্ডার কথায়, ‘যে পরিবর্তনগুলো দেখতে পেয়েছি, সেগুলো আমরা সচরাচর মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া রোগীদের ফাংশনাল এমআরআইতেই দেখতে পাই।’ চিকিৎসক মহল এই গবেষণালব্ধ ফলকে স্বাগত জানিয়েও বলছেন, আরও বেশি সংখ্যক রোগীর উপর গবেষণা চালানো দরকার। কলকাতার চিকিৎসকরাও একই রকমের সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন।
নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনিমেষ কর বলছেন, ‘অতিমারীর পরে ব্রেন ফগিংয়ের সমস্যা খুব সাধারণ। তবে এই সমস্যার তীব্রতা যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব বেশি থাকে না, তাই এ নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসা মানুষের সংখ্যা কম। মূলত দেখা যায়, অন্য সমস্যা নিয়ে আসছেন রোগী। তাঁর রোগের বিস্তারিত ইতিহাস নিতে গিয়ে বুঝতে পারি, রোগী হয়তো ব্রেন ফগিংয়েরও শিকার।’ তিনিও জানাচ্ছেন, কোভিড সংক্রমণের তীব্রতার সঙ্গে ব্রেন ফগিংয়ের সম্পর্ক নেই।
তবে নিউরো-সাইকিয়াট্রির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যাঁদের গন্ধ বা স্বাদ চলে যায় করোনায়, তাঁদের ব্রেন ফগিংয়ের আশঙ্কা বেশি। তাঁর কথায়, ‘করোনা এমন একটা ভাইরাস, যা প্রত্যক্ষ ভাবে স্নায়ুতে প্রভাব ফেলে। তাই যাঁদের গন্ধ ও স্বাদের অনুভূতি বহনকারী স্নায়ু প্রভাবিত হয় কোভিডে, তাঁদের ব্রেন ফগিংয়ের হারও বেশি।’ তাঁরও নিত্য রোগী দেখার অভিজ্ঞতা বলছে, করোনা পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মানুষের ব্রেন ফগিং হচ্ছে। যে ধারাটা শুরু হয়েছিল কোভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে, সেই ধারা এখনও চলছে। কোভিড থেকে সেরে ওঠার এক-দেড় বছর পরেও এই সমস্যা অনেকেরই থাকছে।
আর এক নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, জেট ল্যাগ, হ্যাংওভার, ডিহাইড্রেশন, ধুম জ্বরে যেমন মাথার ভিতরটা যেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে, ব্রেন ফগিংয়ের অনুভূতিটা মোটের উপর তেমনই। এতে দৃঢ় ভাবে কোনও কিছু চিন্তা করা যায় না, চিন্তাভাবনার গতি মন্থর হয়ে যায়, কথা হারিয়ে যায়, মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটে, মন ভুলো হয়ে যায়, চট করে সাধারণ কথা বা শব্দবন্ধও মনে পড়ে না। এই সমস্যা সাধারণত ২০ বছরের নীচে দেখা যায় না এবং ৬০ বছরের উপরে বেশি দেখা যায়-এমনটাই জানাচ্ছেন দেবাঞ্জন। তাঁর আক্ষেপ, সমস্যাটা যে চিকিৎসায় সেরে যায়, সে সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা কম।