গত এক দশক ধরে তিনিই ছিলেন মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার সর্বেসর্বা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা না-দেওয়া, অপ্রিয় প্রশ্নে খানিক বিরক্ত হওয়া – নানা ‘মুড’-এ দেখা যেত মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে। কিন্তু স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে এখন প্রেসিডেন্সি জেলের সেলই তাঁর ঠিকানা।
শুক্রবার, এ বারের মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার দিনে নিজের জন্য বরাদ্দ সেলেই কার্যত বন্দি থাকলেন কল্যাণময়। যদিও খবরের কাগজ পড়েছেন বলেই জেল সূত্রে খবর। ‘আজ মাধ্যমিকের ফল’ শীর্ষক সংবাদে চোখও আটকেছে। জানা গিয়েছে, এক সহবন্দিকে এ দিন বলেছেন, ‘এই দিনটায় কত কী হতো…!’ দুপুরে নাকি বেশি কিছু মুখে তোলেননি। তবে মেনুতে ছিল মুরগির মাংস, আলুরদম ও সব্জি দিয়ে ডাল।
নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একাধিক বার কল্যাণময়কে তলব করেছিল সিবিআই। বাড়িতে ও অফিসে চলে তল্লাশি অভিযানও। গত বছর মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের আগে তাঁকে সিবিআই অফিসে যেতে না হলেও বাগ কমিটির রিপোর্টে কল্যাণময়কে কার্যত দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এমনকী রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রয়োজনে কল্যাণময়ের বিরুদ্ধে এফআইআর করে যেন তদন্ত শুরু করা হয়।
যে কারণে গতবার ফল প্রকাশের দিন নজিরবিহীন নিরাপত্তায় কোনও রকমে সাংবাদিক বৈঠক সারেন তৎকালীন সভাপতি। তারিখটা ছিল ৩ জুন। তার আগে পর্ষদ অফিসকে কার্যত দুর্গে পরিণত করা হয়েছিল। সে বার ওই অফিসে জলপাই রঙের পোশাক পরা পুলিশ, কর্মী-আধিকারিকদের বলয় ছিল চোখে পড়ার মতো। সাংবাদিকদের যাতায়াত ছিল কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত। এমনকী, সাংবাদিক বৈঠকের পর প্রশ্ন-উত্তরেও অংশগ্রহণ করেননি কল্যাণময়। তাঁকে কার্যত ঘিরে ধরে ‘নিরাপদ’ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল কর্মী-আধিকারিকদের বলয়।
তিনি যে ভবনে বসতেন, সেখানে কার্যত মাছি গলার সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। সেই জুনেই পদত্যাগ করেন কল্যাণময়। তারপর গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি তথা নিউ আলিপুর কলেজের রসায়নের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক। এখনও মেলেনি জামিন।
বছর ঘুরে শুক্রবার অবশ্য পর্ষদের ছবিটা ছিল একেবারে আলাদা। মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার দিনটা কার্যত পর্ষদের মহাযজ্ঞের দিন। শুক্রবার এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সাংবাদিক বৈঠক করেন বর্তমান সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। ধরে ধরে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর দেন। অনেকে এ দিন তাঁর ঘরে গিয়েও দেখা করেন।
যেমনটা এক সময়ে কল্যাণময়ের সঙ্গেও করা যেত। রামানুজের কাছ থেকে সাংবাদিক বৈঠকের বাইরেও বেশ কিছু ব্যাখ্যা জেনে নেন সাংবাদিকরা। কোথাও তেমন নিয়ন্ত্রণের বালাই ছিল না। সাংবাদিক বৈঠকে এ দিন সরাসরি পর্ষদের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে রামানুজ বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের দায়বদ্ধতার কোনও ঘাটতি আছে বলে মনে করবেন না। শিক্ষাক্ষেত্রে যে সব অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আদতে সু-প্রশাসনের ইঙ্গিতবাহী।’
আর এক সময়ের দাপুটে প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় জেলে ভালো নেই। আদালতের কাছে একাধিকবার শরীর খারাপের কারণে জামিন চেয়েছেন। কিন্তু কোর্ট তাতে কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশেই তাঁর ইকো কার্ডিওগ্রাফি, ইসিজি এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে। আদালতেও তাঁর কোনও সঙ্গী বা আত্মীয়কে সে ভাবে আর দেখা যায় না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে রেগেই ওঠেন এক সময়ের মাধ্যমিকের সর্বময় কর্তা।