পড়াশোনায় যেমন মেধাবী, তেমনই আঁকার হাতও ছিল ভালো। বাড়ির দরজা ঠেলে ঢুকলে দেওয়ালে তাঁরই হাতের আঁকা ছবি জ্বলজ্বল করছে এখনও। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাঁদের ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়ে চাকরির দিকে না ঝুঁকে বাবার দোকানেই বসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ী হয়ে ওঠাই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা বুঝতে পারলে হয়তো দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হওয়া নীলাদ্রি সিংহকে (২৮) দোকানে বসতেই দিতেন না বাবা-মা।
বুধবার ভর সন্ধ্যায় ব্যারাকপুর ১৪ নম্বর রেলগেট সংলগ্ন ব্যস্ততম আনন্দপুরী ওল্ড ক্যালকাটা রোডের সোনার দোকানে ডাকাতি করতে আসা দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন নীলাদ্রি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নীলরতন সিংহ ও মা শর্মিষ্ঠা কেউই কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। বাড়ির একতলার ঘরে যখন অসহায় বাবা মা কেঁদে চলেছেন, তখন নীলাদ্রির সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী ঐন্দ্রিলা শোকে পাথর হয়ে আছে দোতলার একটি ঘরে। সেই ঘরেই রাখা ছিল প্রথম জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে কেনা উপহার। বুধবার তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে রাতেই ব্যারাকপুর বড়পোলের কাছে সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল নীলাদ্রির।
নীলাদ্রির দূর সম্পর্কের দিদি বর্ণালী ঘোষ বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে ঘটনার পিছনে কোনও পরিকল্পনা রয়েছে। ডাকাতি করতে এসে কিছু নিল না, অথচ আমার ভাইকে খুন করে কাকা ও দোকানের এক কর্মচারীকে গুলি করে পালিয়ে গেল!’ একই অভিযোগ তুলছেন নিহতের বাবা নীলরতন সিংহও। দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি তাঁরও পায়ে লাগে। রাতেই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁর অভিযোগ, দোকানটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাড়িওয়ালার তরফে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আদালতে এই নিয়ে মামলাও চলছে। নীলরতন বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় যখন একসাথে চার দুষ্কৃতী দোকানে ঢোকে তখন ছেলে বুঝতে পেরে আটকাতে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম ছেড়ে দে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং যান নিহতের বাড়িতে। সাংসদের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে নীলরতন বলেন, ‘কেন যে ছেলেকে দোকানে বসাতে গেলাম!’ দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক থেকে মাত্র পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল ঐন্দ্রিলার সঙ্গে। শোকে পাথর তরুণী বুধবার রাত থেকে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছেন। নীলাদ্রির সেজ জেঠিমা শিপ্রা সিংহ বলেন, ‘দোকান থেকে গয়নাগাঁটি নিয়ে ছেলের জীবনটা তো বাঁচিয়ে রাখতে পারত!’
এ দিন দুপুরে নিহতের বাড়িতে হাজির হন প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তড়িৎবরণ তোপদার, সিটু নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তাপস মজুমদার, শুভঙ্কর সরকাররা। গার্গী বলেন, ‘রাজ্যের পুলিশ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে বড় বড় নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত।’ অর্জুন সিংও টিটাগড় থানার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কিছু রাজনৈতিক নেতার কথা মতো কাজ করে টিটাগড় থানা। ভুঁড়িওয়ালা পুলিশ দিয়ে কি আর দুষ্কৃতী দমন করা যায়?’
এ দিন নীলাদ্রির দেহ ময়না তদন্তের পর বিকেলে বাড়িতে পৌঁছলে মালা দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান ব্যারাকপুরের বিধায়ক রাজ চক্রবর্তী। রাতে ব্যারাকপুর রাসমণি ঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় নীলাদ্রির।