সকাল থেকেই বেজায় ব্যস্ত তিনি। জগন্নাথদেবের অঙ্গরাগ নিয়ে।
সোমবার সকাল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে প্রকৃতি অনেকটা ঠান্ডা। তারই মধ্যে হাওড়ার কদমতলার বৃন্দাবন মল্লিক লেনের শেখ মকবুল ইসলামের দম ফেলার সময় নেই। কারণ, আজ, মঙ্গলবার রথযাত্রার দিনেই তিনি বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন নিমকাঠের তৈরি বলরাম, জগন্নাথ ও সুভদ্রার মূর্তি। তার আগে মূর্তি রং করা, সজ্জা পরানোর কাজ চলছে পুরোদমে। তাঁর এই কাজে সঙ্গী তাঁর গুরুজি দীনেশ খাঁ।
কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের সেন্ট পল্স কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মকবুল ইসলাম গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে জগন্নাথদেবের উপর গবেষেণা করে চলেছেন। আর তিনি এই কাজের বড় স্বীকৃতিও পেয়েছেন। পুরীর মন্দির কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিরলের মধ্যে বিরলতম পুরস্কার ‘নবকলেবর অ্যাওয়ার্ড’।
২০১৫ সালে এই পুরস্কার মকবুল ইসলাম নিয়েছিলেন স্বয়ং শঙ্করাচার্যের হাত থেকে। সেই ইস্তক প্রতি বছরই রথযাত্রার সময়ে ইস্কন, পুরীর মন্দির কমিটি কিংবা হুগলির বন্দিপুর রথযাত্রা কমিটি এবং হাওড়া জেলায় রথযাত্রার বিভিন্ন আয়োজকদের থেকে আমন্ত্রণ পান তিনি। যেতেও হয় তাঁকে।
কিন্তু এ বার মকবুল স্যর কোনও আমন্ত্রণই নেননি। তাঁর কথায়, “এ বার রথযাত্রার দিনটা আমি রেখেছি শুধু নিজের জন্য। বাড়িতে প্রভু জগন্নাথদেবকে প্রতিষ্ঠা করব বলে।” হাওড়ার বাগনানের এক গরিব সুফিপন্থী মুসলিম পরিবারের সন্তান মকবুল স্যরের পড়াশোনা, শিক্ষকতা, গবেষেণা সব কিছুই কদমতলায় বনেদি হিন্দু পরিবার, দীনেশ খাঁ-র বাড়িতে।
এই বাড়িতে বসেই মকবুল স্যর নিয়ম করে রোজা রাখেন, নমাজ পড়েন, সরস্বতী পুজোর কাজে হাত লাগান। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে নিয়ম করে স্মরণ করেন তিনি সেখানেই এবং বৈষ্ণব পদাবলীতেও ডুবে থাকেন। দীনেশ খাঁ-ও এক সময়ে সেন্ট পল্স কলেজে বাংলার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
তার পরে তাঁর জায়গা নিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র আনন্দ অর্থাৎ মকবুল ইসলাম। দীনেশের বাড়িতে গেলে মিলবে জগন্নাথদেবকে নিয়ে লেখা নানা ভাষার অজস্র বই। যার মধ্যে গোটা দশেক বইয়ের লেখক মকবুল ইসলাম নিজেই।
সোমবার সকালে নানা কাজের ফাঁকে নিজের স্টাডি-তে বসে মকবুল স্যর দেখাচ্ছিলেন তাঁর নতুন বইয়ের প্রস্তুতি। কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর এমনকী শ্রীলঙ্কাতেও জগন্নাথদেব কী ভাবে জনমানসে প্রভাব ফেলেছেন, তা নিয়েই ইংরেজিতে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর এই নতুন বই। এই বই লেখার জন্য ওই সব দেশে চষে বেড়িয়েছেন তিনি।
মকবুল স্যর বলছিলেন, “জগন্নাথদেব হলেন ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক। ভাই-বোনকে নিয়ে তাঁর চেহারা সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। তিনি সত্যিই জগৎ নাথ। আজ বহু ছেলেমেয়ে তাই জগন্নাথদেবকে আরও বেশি করে জানতে গবেষেণা চালাচ্ছে।”
সেন্ট পল্স একটি মিশনারি কলেজ হলেও সেখানে মকবুল ইসলামের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে জগন্নাথদেব রিসার্চ সেন্টার। যেখানে গবেষেণার কাজ করছে নতুন প্রজন্ম।
মকবুল স্যর স্বপ্ন দেখেন, এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে আর প্রভু জগন্নাথের আশীর্বাদে ধর্মের নামে হানাহানি একদিন বন্ধ হবে।