বিষ্যুৎবারের বারবেলায় বিরস বদনে বসে থাকে দাবাং, রামিয়া, মাধবীরা। উত্তরকন্যা, দামালদেরও মুড ভালো থাকে না মোটেই। ওদের যে সারা দিনের উপোস। নির্জলা নয় অবশ্য, ওই জলটুকুই জোটে স্রেফ। কিন্তু তবু কোনও হাঁকডাক করে না ওরা। ব্যাজার মুখ করে মেনে নেয় সব কিছু। ফিট থাকতে হলে যে স্ট্রিক্টলি মানতেই হবে হপ্তায় একদিন না খেয়ে থাকার এই নিয়ম। ফিটনেস ফ্রিক না হলেও সেই নিয়ম বিনা প্রতিবাদেই মেনে নিয়েছে ওরা।
এরা সবাই জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ খয়েরবাড়ি চিতাবাঘ পুনর্বাসন কেন্দ্রের আবাসিক লেপার্ড। ওদের মতো মোট ২১টি চিতাবাঘ আপাতত রয়েছে দক্ষিণ খয়েরবাড়িতে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রের আশপাশে গেলে কানে ভেসে আসে ওদের ডাকাডাকি, তর্জন-গর্জন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বৃহস্পতিবার আসতেই ওরা যেন ঝিমিয়ে পড়ে। বেলা দেড়টার পর থেকেই একদমই কমে যায় ওদের চঞ্চলতা। আসলে সপ্তাহে একটা দিন ওদের উপোস করিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ওরা কী করে বোঝে, বৃহস্পতিবার মানেই উপোসের দিন। বৃহস্পতিবার করেই কেন মুড অফ থাকে ওদের?
রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মুখ্য বনপাল রবিকান্ত সিনহা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ছাড়া বাকি দিনগুলিতে সকাল থেকেই ওদের খাবার দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মাংসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গোটা চত্বরে। কিন্তু বৃহস্পতিবারে ছবিটা আমূল বদলে যায়। ওই দিন উপবাসের কারণে শুধুমাত্র জল দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে যান চিড়িয়াখানার কর্মীরা। খাবার দেওয়ার তৎপরতাও থাকে না। তা থেকেই ওরা বুঝতে পারে যে, আজ আর খাবার মিলবে না। ওরা তো আর বৃহস্পতিবার বলে আলাদা কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর যে খাবার বন্ধ থাকবে, তা ওদের বডি ক্লক ঠিক ধরে ফেলে। একটা সময় এটা মেনে নিতে বাধ্য হয় ওরা। তার ফলেই বৃহস্পতিবার করে ঝিমিয়ে থাকে।’
কিন্তু কেন এই উপোসের নিয়ম?
রাজ্য জু অথরিটির সদস্য সচিব সৌরভ চৌধুরী বললেন, ‘বন্দি মাংসাশী প্রাণীরা অলস বসে থাকে। নিয়মিত মাংস দিলে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন তাদের কিডনির উপর মারাত্মক চাপ তৈরি করে। সেই চাপ কমাতেই আমাদের রাজ্যের চিড়িয়াখানাগুলিতে সব মাংশাসী প্রাণীদের বৃহস্পতিবার করে অটোফাজিতে (autophagy) যেতে বাধ্য করা হয়।’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘যে মাংসাশীরা প্রকৃতিতে থাকে, তাদের শিকারের জন্য প্রচুর কসরত করতে হয়। আর প্রতিদিন যে তারা শিকার পায়, এমনও নয়। অর্থাৎ প্রকৃতিই তাদের ‘অটোফাজি’ করতে বাধ্য করে। বন্দিজীবনে কসরতের সুযোগ কোথায়? তাই বৈজ্ঞানিক কারণেই আমরা চিড়িয়াখানার মাংসাশী প্রাণীদের সপ্তাহে একটা দিন উপবাসে রেখে প্রচুর জল খাওয়াই, কিডনি পরিষ্কার করার জন্যে।’
কী এই অটোফাজি?
অটোফাজি হলো একটি বিশেষ প্রাকৃতিক নিয়ম, যার মাধ্যমে কোষ তার নিজের মধ্যের অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলি অপসারিত করে, সঙ্গে নতুন ও সুস্থ কোষ তৈরি করার জন্য নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে অপসারণ করে। ২০১৬ সালে বিখ্যাত জাপানি কোষ জীবতত্ত্ববিদ ইয়োশিনোরি ওসুমির গবেষণায় আবিষ্কৃত হয় অটোফাজির তত্ত্ব। যার জন্যে তাঁকে ওই বছর নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।
সোজা বাংলায় বলা যায়, উপোসের মাধ্যমে শরীর ফিট রাখা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ খয়েরবাড়ির এক জন অভিজ্ঞ বনকর্মী বললেন, ‘মাংসাশী বন্যপ্রাণীরা শিকারের খোঁজে একদিনে কমপক্ষে কুড়ি কিলোমিটার এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। আমাদের এখানে তো সে সুযোগ নেই। লোহার গরাদে বন্দিদশায় কাটে ওদের দিন। শারীরিক কসরতের বিশেষ সুযোগই নেই। তাই সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে ওদের বরাদ্দ, চিকেন অথবা বিফ দেওয়া হলেও, বৃহস্পতিবার করে খেতে দেওয়া হয় না।’ তাঁর কথায়, ‘বৃহস্পতিবার এলেই ওরা যেভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তাতে মায়ায় পড়ে আমরাও ওই দিনটায় খাঁচার আশপাশে খুব একটা দরকার না পড়লে যাই না।’