Bankura Mecha Sandesh : জিআই ট্যাগে বেলিয়াতোড়ের গণ্ডি পেরোতে চায় মেচা সন্দেশ – west bengal national university of juridical sciences has applied for gi tag to mecha sandesh of beliatore bankura


দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
রুখা-শুখা মল্লভূমে তখন দুধের আকাল। ফলে ছানার মিষ্টি তৈরি প্রায় অসম্ভব। অথচ মল্লরাজাদের পাতে মিষ্টি পড়বে না তা কি হয়? ফলে বিস্তর মাথা খাটিয়ে দুধ, ছানা ছাড়াই আবিষ্কার হলো এক মিষ্টির। বেসন, ঘি, এলাচ আর চিনির রসে পাক দেওয়া সেই মিষ্টি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। যার সঙ্গে তুলনায় আসতে পারে জনাইয়ের মনোহরা। মল্লভূমের সেই মিষ্টিই বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশ। চিনির রসের আস্তরণ থাকে এই মিষ্টিতে। সেই চিনি প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করায় দীর্ঘ দিন তাজা রাখা যায় মেচাকে। এথনিক এবং ইন্ডিজেনাস (স্বদেশি) শিল্পকর্ম হিসেবে যার জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগের আবেদন জানিয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি অফ জুরিডিক্যাল সায়েন্স।

Wood Puppet : বছরভর ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভে আসবাবপত্রেও কাঠের পেঁচা
প্রতিষ্ঠানের আইপিআর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) চেয়ার প্রফেসর পিনাকী ঘোষ জানিয়েছেন, জিআই ট্যাগ পাওয়ার তিনটি পর্ব থাকে। প্রথম দু’টি পর্ব মিটেছে। তিন নম্বর বা শেষ ধাপের পরেই মিলবে স্বীকৃতি। বাঁকুড়া-দুর্গাপুর রাজ্য সড়কের উপর বড়জোড়া ব্লকের বেলিয়াতোড় গ্রামই হলো মেচা সন্দেশের আঁতুড়ঘর। দুর্গাপুর থেকে ২৩ আর বাঁকুড়া থেকে ২১ কিমি দূরত্বের এই বেলিয়াতোড় নামেরও ইতিহাস রয়েছে। শালী নদীর তীরে এই গঞ্জ এলাকায় একসময় খুব বন্যা হতো। বন্যার পর তৈরি হতো বালির পাহাড়। ফলে বালুরতট থেকে এলাকাটির নাম হলো বালুরতটি। ক্রমে সেই নাম লোক মুখে হলো বালুতোড়। আর সেই বালুতোড়ই আজকের বেলিয়াতোড়। সেখানেই হাতছানি দেয় জিভে জল আনা দু’শো বছরেরও প্রাচীন এই সন্দেশ।

Mysore Pak : চুরি করা রেসিপিতেই রাজহেঁশেলে তৈরি সেরা মিষ্টির তকমাপ্রাপ্ত মাইসোর পাক? জানুন ইতিহাস
বেলিয়াতোড় পঞ্চায়েত এলাকায় আর মাত্র ৩০টি দোকান রয়েছে যারা এই মিষ্টির কারিগর। তার মধ্যে বেলিয়াতোড় মোড়ে রয়েছে প্রায় ১৭টি দোকান। মোড়ের দোকানগুলির মধ্যে ৫-৬টি খুবই পুরোনো। কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছে তাদের মেচার কারবার। তেমনই একটি আদি প্রতিষ্ঠান চন্দ্রলোক সুইটস। দোকানের মালিক প্রশান্ত মোদক বলেন, ‘৬-৭ পুরুষ ধরে আমাদের মেচা সন্দেশের ব্যবসা। চিরাচরিত মেচা তৈরি করতে লাগে বুটের বেসন, চিনি, ঘি ও ছোট এলাচ।

Tripura Government : ব্যবসার ডেস্টিনেশন হোক ত্রিপুরা! হস্তশিল্প সংরক্ষিত করতে GI ট্যাগ চাইছেন মানিক সরকার
তবে সময়ের সঙ্গে এই মিষ্টি আপডেটেড হয়েছে। স্বাদ বাড়াতে এখন খোয়াক্ষীর মিশিয়ে মেচা সন্দেশ তৈরি হচ্ছে।’ এই ক্ষীরের মেচার দাম একটু বেশি পড়লেও চাহিদা ভালো। প্রতি পিস ১৫ টাকা। জিআই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা জিআই ট্যাগের দাবি রেখেছি। জিআই ট্যাগ পেয়ে গেলে এই মিষ্টির স্বকীয়তা এবং দাবি একমাত্র আমাদেরই থাকবে। তখন অনলাইনেও মেচা সন্দেশ পাঠাতে পারব।’ বেলিয়াতোড়ের ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, জিআই স্বীকৃতি পেলেই তাঁরা মেচা সন্দেশকে সারা বাংলার সঙ্গে ভিন রাজ্যেও পাঠানো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবেন। জিআই-এর জন্য গঠিত সমিতির সম্পাদক মনোজ মোদক বলেন, ‘জিআই স্বীকৃতি পেলে ব্র্যান্ড তৈরি হবে। তখন বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশের কদর আরও বাড়বে।’

এবার দুধ দিয়ে তৈরি করুন বিরিয়ানি, তেল-মশলা বিহীন এই পদের নাম ‘দুধ কি বিরিয়ানি’
মেচা সন্দেশ তৈরির প্রক্রিয়া সহজ নয়। দুই থেকে তিন দিন লাগে এই সন্দেশ তৈরি করতে। এই মিষ্টি তৈরিতে রয়েছে ৬টি স্তর। প্রথম স্তরে মিষ্টির মূল উপকরণ ছোলা থেকে পাওডার তৈরি করা। আগে এই কাজ ঢেঁকিতে হলেও এখন মিক্সারে করা হয়। বর্তমানে অবশ্য শিল্পীরা বাজার থেকে ভালো মানের বেসন কেনেন। এর পর উৎকৃষ্ট মানের ঘিতে সেই বেসন দিয়ে তৈরি হয় গাঠিয়া। এবার সেই গাঠিয়াকে আবার মিহি গুঁড়ো করা হয়। তৃতীয় স্তরে এই মিহি গাঠিয়ার সঙ্গে মেশানো হয় খোয়াক্ষীর। এখানে বলে রাখা ভালো, মেচায় মেশানো খোয়াক্ষীরের জন্য ভালো দুধের প্রয়োজন। দুধ যত ভালো হবে, ক্ষীরও হবে তত ভালো। স্বাদের জন্য ক্ষীরে মেশানো হয় চিনি।

চতুর্থ পর্বে বেসনের সঙ্গে ক্ষীরের পাক তৈরি হয়। এই পাকের সঙ্গে কাজু, এলাচ মেশানো হয়। সঠিক মাত্রায় মেশানোর পর এবার শিল্পীরা মণ্ড থেকে গোল্লা পাকিয়ে লাড্ডুর আকার তৈরি করেন। ইতিমধ্যে কড়াইয়ে তৈরি হয় চিনির সিরাপ। জলের মধ্যে চিনি দিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় এই রস। সেই রসে একটা করে ডোবানো হয় লাড্ডু। জ্বাল দেওয়া সম্পূর্ণ হলে সেই লাড্ডু বসিয়ে রাখা হয় শালাপাতার উপরে। একেবারে শেষ পর্বে মেচাকে শালপাতা থেকে তুলে দোকানে পরিবেশনের পাত্রে রাখা হয়।

Hilsa Fish : ইলিশের ঢল, কিন্তু কতটা সুবাসিত বং হৃদয়?
এনইউজেএস-এর চেয়ার প্রফেসর জানাচ্ছেন, ওই এলাকায় শালগাছের আধিক্যের কারণে এই পদ্ধতি শুরুর সময় থেকে চলে আসছে। একইসঙ্গে তিনি জানান, এই সন্দেশ তৈরিতে আগে চিনি ব্যবহার করা হতো না। চিনি অনেক পরে এসেছে। আগে গুড় দিয়ে তৈরি হতো এই মিষ্টি। একই মত জানিয়েছেন, বেলিয়াতোড়ের অন্যতম আদি দোকান মেচা মহলের বর্তমান মালিক ভগবানদাস মোদক। তিনি বলেন, ‘আগে মেলায় বিক্রি হতো গুড়ের মেচা। বর্ষায় ভেজা আবহাওয়ার কারণে গুড়ের পাক নষ্ট হয়ে লাড্ডুতে জল কেটে যেত।’ ভগবানদাসের দাবি, তাঁর প্রপিতামহ গিরীশচন্দ্রদাস মোদকই আবিষ্কার করেছিলেন মেচা।

বেলিয়াতোড় রেল স্টেশনের কাছে মেচা সন্দেশের কারখানা হীরালাল দে’র। প্রতিষ্ঠানের নাম হীরা মেচা সেন্টার। তিনি জানান, বর্ধমানে জাতীয় সড়কে বাস থামিয়ে ল্যাংচা কেনার মতো এখানেও মেচা সন্দেশ কেনা হয়। তবে শুধু ফ্লাইং কাস্টমারের উপর নির্ভর করে ব্যবসা চলে না। স্থানীয় মানুষও প্রচুর পরিমাণে কেনেন এই সন্দেশ। তার সঙ্গে কুটুমবাড়িতে গেলে মেচা সন্দেশ নিয়ে যাওয়ার চলও রয়েছে। ফলে এখানে সন্দেশের গুণগত মান বজায় রাখতে হয় তাঁদের। তবে একইসঙ্গে হীরালাল জানান, তাঁর কারখানা থেকে ট্রেনে, বাসে ফিরি করার জন্য হকাররা মেচা কিনে নিয়ে যান। সেই মেচার দাম ও কোয়ালিটি অবশ্য দোকানের সঙ্গে তুলনীয় নয়।

Tripura Queen Pineapple : ব্যবসার ‘ডেস্টিনেশন’ হবে ত্রিপুরা! GI ট্যাগ পাওয়া আনারসেই লাভের আশা
এখন এই ইন্ডিজেনাস মিষ্টি তৈরি করেন মাত্র ১৫-২০টি পরিবার। ফলে বাংলার এই ঐতিহাসিক মিষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে জিআই ট্যাগের স্বীকৃতি পেতে কাজ চলছে। এনইউজেএস-এর অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের একটি টিম ওখানে মিষ্টিশিল্পীদের সাহায্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। একটি সমিতি গঠন করা হয়েছে। তার মাধ্যমে সব তথ্য পাঠানো হয়েছে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি অ্যান্ড প্রোমোশনে। আশা করছি, আর কয়েক মাসের মধ্যেই জিআই ট্যাগ পেয়ে যাবে বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশ।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *