কেউ পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ ফাঁদে পা দিচ্ছে, কেউ বা আবার নিজে থেকেই চলে যাচ্ছে – সকলেই পুলিশের খাতায় নিখোঁজ। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে ও তৃতীয় লিঙ্গ নির্বিশেষে এই ঘটনা ঘটছে। অনেকেই ফিরে আসছেন বা উদ্ধার হচ্ছেন, আবার অনেকেরই খোঁজ থাকছে না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পুরো দেশেরই ছবি এটা। গত ২৬ জুলাই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একটি লিখিত প্রশ্নের উত্তরে এনসিআরবি-র তথ্য অনুসারে জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত নাবালিকা ও মহিলা মিলিয়ে নিখোঁজের সংখ্যা ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৫১১ জন।
তবে কত সংখ্যক উদ্ধার হয়েছে, সে তথ্য ওখানে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এনসিআরবি-র ওয়েবসাইটে যে রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এই সংখ্যা ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৮৯ জন। এই ৩৫,২৭৮ জনের ফারাক কেন একই সংস্থার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই ধারণা, কোনও ডেটা রিভিশনের ফলে এমন হয়ে থাকতে পারে, তবে তাঁদের ব্যাখ্যা, ‘রাজ্যসভায় যখন ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া উল্লেখ করেই এই তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা হলে তাকে মান্যতা দিতেই হবে।’
পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় অবশ্য বাংলা থেকে প্রাপ্ত নিখোঁজ নাবালিকার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ‘গত বছরের এপ্রিল থেকে এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে নিখোঁজ হয়েছিল ৯৮৭২ জন মেয়ে। তাদের মধ্যে ৯৬০৩ জন উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে ৬৯ জন বাংলাদেশি ও ১৬ জন নেপালিকে দেশে পাঠানো হয়েছে।’
তবে ২০২১ সালের ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ বলে যে বার্ষিক রিপোর্ট এনসিআরবি প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলায় নাবালিকাদের উদ্ধারের গড় ৬০ শতাংশ। মহিলাদের ক্ষেত্রে তা ৪৭ শতাংশের মতো। এক পুলিশ কর্তা ‘এই সময়’কে স্পষ্ট জানান, অনেকেই নিজের ইচ্ছায় চলে যান, তাঁরা ফিরে আসেন না। সে জন্য মহিলাদের খুঁজে পাওয়ার হার বেশ কম। আবার এ-ও দেখা গেছে, যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের কথা মোটেই পুলিশকে জানানো হচ্ছে না, ফলে তাঁদের নাম নিখোঁজের খাতাতেই থেকে যাচ্ছে।
একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের অভিজ্ঞতায় জানিয়েছে, রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় অত্যধিক দারিদ্র্য ‘পুশ ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে। সে জন্যই কাজের টোপ, বিয়ের টোপ-সহ আরও নানা ভাবে মেয়েদের ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে বা দেশে। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ আধিকারিক বললেন, ‘সব নিখোঁজ মানেই পাচার তা মোটেই নয়, কিন্তু সব পাচারই নিখোঁজ। এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। করোনা ও তার পরবর্তী সময়ে বাল্য বিবাহ নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। এ জন্য ইলোপমেন্ট ও পাচার – দুটোই বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এই বিষয়গুলি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ক্রাই-এর রিজিওনাল ডিরেক্টর (ইস্ট) তৃণা চক্রবর্তী বললেন, ‘এত মেয়েদের যে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ ও সহযোগী এনজিওদের তৎপরতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তবে এই নিখোঁজ বহুবিধ কারণে হতে পারে। তা রুখতে আমাদের সকলকে একসঙ্গে পদক্ষেপ করতে হবে।’
সংলাপ-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার সৌরভ বসু মনে করছেন, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন বেশ বড় ভূমিকা পালন করে এ ক্ষেত্রে। কন্যাসন্তানকে তাচ্ছিল্য এখনও সমাজের অসুখ।
তবে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘খাতায়-কলমে অনেক নির্দেশ থাকে। সব সময়ে তা মেনে চলা সম্ভব হয় না, সে ক্ষেত্রে তদন্তই ব্যাহত হয়। এখন নাবালিকা উদ্ধারে বাড়তি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে পুলিশকে, সে জন্য বিশেষ তহবিলও রয়েছে। কিন্তু যে কোনও নিখোঁজের ক্ষেত্রেই তৎপরতার সঙ্গে পদক্ষেপ করা হয়, সে জন্য কোনও আত্মসন্তুষ্টি নেই। মেয়েরা এখানে নিরাপদ।’