তবে কি সত্যিই গঙ্গার গঙ্গাপ্রাপ্তি আসন্ন?
কলকাতা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে গঙ্গার জলের নমুনা পরীক্ষা করে সম্প্রতি যে-সব রিপোর্ট উঠে আসছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্টই কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একাধিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দূষণের জেরে কলকাতার গঙ্গায় অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমছে। বাড়ছে জলের তাপমাত্রা। তার প্রভাবে মাছেদের প্রজনন-ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
গঙ্গায় বেশ কয়েক প্রজাতির মাছের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কমে গিয়েছে। আগামী দিনে গঙ্গা থেকে মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিনা, সে আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। গঙ্গায় যে-সব শ্যাওলা, ছোট ছোট উদ্ভিদ এবং পোকামাকড় জন্মায়, সেগুলির অস্তিত্বও সঙ্কটে। সামগ্রিক ভাবে গঙ্গার বাস্তুতন্ত্রই বিপন্ন। এর প্রভাব পড়তে চলেছে গঙ্গাপাড়ের বাসিন্দাদের উপরেও।
কেন কমছে অক্সিজেন?
বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা অববাহিকায় বিশেষ কোনও ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটছে কিনা, তা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা চালাচ্ছেন ‘এস্টুয়েরিন অ্যান্ড কোস্টাল স্টাডিজ ফাউন্ডেশন’ (ইসিএসএফ)-এর বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কোও। ইসিএসএফ-এর একাধিক বিজ্ঞানী কলকাতা এবং তার আশপাশে গঙ্গায় লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। এঁদেরই অন্যতম মহম্মদ মনিরুজ্জামান।
তিনি ২০১৫ থেকে গঙ্গা নিয়ে গবেষণারত। উত্তরে কাটোয়া থেকে দক্ষিণে নামখানা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে গঙ্গার জলের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখেছেন তিনি। তাঁর গবেষণা-রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সব এলাকায় গঙ্গার জলে অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে সাড়ে চার থেকে ছ’মিলিগ্রামের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। কোথাও আবার সেটা চার থেকে সাড়ে চারে নেমেছে। ওই সব এলাকায় গঙ্গায় ক্ষারের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে।
জলে ক্ষারের পরিমাণ তথা পিএইচ মাত্রা ৭ থেকে ৭.৫ হলে সেটাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। তার বেশি হলেই চিন্তা। সেখানে হাওড়ার আশপাশে গঙ্গায় ক্ষার বা অ্যালকালাইনের পরিমাণ তথা পিএইচ মাত্রা ৮.৫ থেকে ৯! ফলে গঙ্গায় অক্সিজেনের লেভেলও নীচে নামছে। তাতে মাছেদের উপরে প্রভাব পড়ছে। চন্দননগর, কাটোয়া, নবদ্বীপ, বজবজ-সহ বিভিন্ন জায়গায় সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ওই সব অঞ্চলে গঙ্গায় অক্সিজেনের মাত্রা যেমন কমেছে, তেমনই মাছের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে।
চাঁদা মাছ, রাঙা মাছ, চিতল, ফলুই-সহ বেশ কয়েক প্রজাতির মাছের আর দেখা মিলছে না। গঙ্গায় চিতল, ফলুইয়ের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। মাছেদের প্রজননের সময়সীমাও কমে গিয়েছে। আগে মে থেকে অগস্ট মাস পর্যন্ত প্রজনন চলত। এখন সেটা অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সীমিত হয়ে গিয়েছে। কলকাতা এবং তার আশপাশে গঙ্গায় আর আগের মতো মাছ মিলছে না।
গঙ্গায় মিশছে ভারী ধাতু
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সের গবেষক ভাস্করদেব ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে গঙ্গায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি এবং তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, কলকাতার দু’পাশে গঙ্গায় খুব বিপজ্জনক মাত্রায় জিঙ্ক, লেড, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গিয়েছে। সবথেকে খারাপ অবস্থা বাবুঘাট, শোভাবাজার, বাগবাজার, বজবজ, ডায়মন্ড হারবার এবং ব্যারাকপুর অঞ্চলে। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর বিসর্জনের সময়ে বাবুঘাটের কাছে গঙ্গায় অস্বাভাবিক মাত্রায় হেভি মেটাল পাওয়া গিয়েছে।
ভাস্করের ব্যাখ্যা, ‘কলকাতার গঙ্গায় বায়ো অ্যাকুমুলেশন রেট বড্ড বেশি। গঙ্গায় প্রচুর পরিমাণ হেভি মেটাল আসছে। গঙ্গায় যে সব মাইক্রোবস (আণুবীক্ষণিক প্রাণী) রয়েছে, তারা ভারী ধাতু ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। সেই সূত্রে মাইক্রোবসদের দেহেও ঢুকছে ভারী ধাতু। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের দেহেও প্রবেশ করছে। মাছেরা আবার সেগুলো খাচ্ছে। তা থেকে মানবদেহে ঢোকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডায়মন্ড হারবারের পর থেকে আবার গঙ্গার জলে প্রচুর পরিমাণ আর্সেনিকও মিলেছে। সেটাও গঙ্গার জলজ প্রাণীদের পক্ষে বিপজ্জনক’।
গঙ্গাপাড়ে ম্যানগ্রোভ কীসের ইঙ্গিত?
লোকে ম্যানগ্রোভ দেখার জন্যে সুন্দরবনে ছোটেন। প্রচলিত ধারণা হলো, ম্যানগ্রোভ সাধারণত লবণাক্ত ভূমিতে জন্মায়। কিন্তু এখন কলকাতা এবং তার আশপাশে গঙ্গার পাড়েও ম্যানগ্রোভ জন্মাচ্ছে। বছরখানেক আগে হুগলির চন্দননগরের কাছে গঙ্গার তীরে ম্যানগ্রোভের চারা বসিয়েছিলেন স্থানীয় কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সুন্দরবনের ‘পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি’।
সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা পেশায় ভূগোলের শিক্ষক উমাশঙ্কর মণ্ডল জানাচ্ছেন, চন্দননগরে যতগুলো ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছিল তার বেশিরভাগই জীবিত। এখন নতুন ডালপালা গজাতে শুরু করেছে। এতে উৎসাহী হয়ে অনেকেই এখন গঙ্গার তীরে ম্যানগ্রোভ লাগাতে শুরু করেছেন। চলতি মাসে আউটরাম ঘাটের কাছে প্রায় হাজারখানেক ম্যানগ্রোভের চারা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য বনদপ্তরও। তা দেখে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, গঙ্গার জলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াতেই কি কলকাতা এবং তার আশপাশে ম্যানগ্রোভ মাথা তুলছে?
খাড়ি-গবেষক সৌরভ পাল বলছেন, ‘গঙ্গার লবণাক্ততা বেড়েছে, এ রকম প্রমাণ নেই। গঙ্গার পাড়ে ম্যানগ্রোভের বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক ঘটনা। তার সবথেকে বড় প্রমাণ কেওড়াতলা মহাশ্মশান। কেওড়া গাছ থেকেই এই নামের উৎপত্তি।’ সৌরভের দাবি, এক সময়ে কলকাতার গঙ্গায় সমুদ্রের নোনা জল ঢুকত। তখন এখানে অনেক ম্যানগ্রোভ দেখা যেত। পরবর্তীকালে মানুষই সেগুলোকে কেটে ধ্বংস করেছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রাজ্য প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ‘ডিরেক্টরেট অফ রিসার্চ, এক্সটেনশন অ্যান্ড ফার্মস’-এর সহ অধিকর্তা বিমলকিঙ্কর চন্দ্রের ব্যাখ্যা, নিকাশিনালার দূষিত জল এবং আবর্জনা যখন নদীতে গিয়ে মেশে সেখানে পচন তৈরি হয়। ফলে নদীর জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। মাছের বৃদ্ধি কম হয়। মাছের প্রজনন-ক্ষমতা হ্রাস পায়। সে রকম হলে মাছ অন্য জায়গায় চলে যায়।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত জানান, কলকাতা এবং তার আশপাশে গঙ্গার দুই পাড়ে মোট ২২২টি নিকাশিনালা রয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় কোনও সুয়েরেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না থাকায় নালার জল সরাসরি মিশছে গঙ্গায়। তার মাধ্যমে কসমেটিক্স, সানস্ক্রিন, শ্যাম্পু, সাবানের জল নর্দমা দিয়ে গঙ্গায় প্রবেশ করছে। গঙ্গার পাশে অনেক বড় বড় কারখানা রয়েছে। সেখানকার বর্জ্যও পড়ছে গঙ্গায়। তিনি বলেন, ‘যে ভাবে গঙ্গা দূষিত হচ্ছে, এটা বন্ধ করা না গেলে একদিন গঙ্গা খোলা ড্রেনে পরিণত হবে।’