প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল সপ্তাহ খানেক আগেই। রবিবার ছুটির দিনটা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল কলেজ পড়ুয়া তরুণের। কিন্তু বাবার ডাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দত্তপুকুরের মোচপোল গ্রামে বাজির কারখানায় কাজে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন ২১ বছরের রবিউল আলি। কাজে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্ফোরণে বাবার সঙ্গেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তরতাজা তরুণের দেহ। বাড়িতে পড়ে রইলেন মা, আদরের ছোট বোন, ভালোবাসার সঙ্গী।
দত্তপুকুরে বাজি কারখানায় অন্যতম অংশিদার কেরামত আলির প্রথম পক্ষের ছেলে রবিউলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না পাড়া প্রতিবেশীরাও। কেরামতের উপর এলাকার মানুষ বীতশ্রদ্ধ থাকলেও ভদ্র, শান্ত স্বভাবের রবিউলকে স্নেহ করতেন সকলেই। কেরামত আর একটি সংসার পাতায় দুই নাবালক ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রুবি বিবি। গত ১৭ বছর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না তাঁর। কিন্তু মা ও বোনকে নিয়ে তিনজনের সংসার চালাতে সেই সংসারত্যাগী বাবার উপরেই নির্ভর করতে হতো রবিউলকে। মধ্যমগ্রাম বিবেকানন্দ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটি সপ্তাহে দু-তিন দিন বাবার বাজি কারখানায় কাজ করতেন। ওই সামান্য উপার্জনেই নিজের এবং বোনের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার খরচেও মাকে সাহায্য করতেন রবিউল।
একসঙ্গে পড়ার সূত্রে কলেজেরই এক ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মিশুকে রবিউল। নাতির ইচ্ছায় সায় দিয়ে তাঁর দাদু নুর মহম্মদ মণ্ডল ও পরিবারের কয়েকজন দিন সাতেক আগে রবিউলের প্রেমিকার রহড়ার বলাগড়ের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন। রবিউলের ইচ্ছা ছিল আগে বোনের বিয়ে দিয়ে নিজে বিয়ে করার। তাই দুই পরিবার মিলে বছর দুয়েক পর একটা ভালো দিন দেখে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে নেয়।
রুবি বিবির কথায়, ‘রবিবার সকাল আটটা নাগাদ ওর বাবা কেরামত ওকে ফোন করে কারখানায় কাজে ডাকে। ছেলে যেতে চাইছিল না। এগারোটার সময় বন্ধুদের সঙ্গে ওর ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। ওর বাবা বলে তাড়াতাড়ি কাজ থেকে ছেড়ে দেবে। সকাল দশটা নাগাদ বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে আমি ছুটে যাই সামসুলের বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখি চারপাশে আগুনের মাঝে পড়ে গোঙাচ্ছে আমার ছেলে। ওর মুখটা পুরো ঝলসে গিয়েছিল।’
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে রুবি বলেন, ‘ছেলেটা জল খেতে চাইছিল। ওর মুখে একটু জল দিই। তার পর আমিই কোলে করে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার ছেলেকে বাঁচানো গেল না।’ রবিউল মাংস খেতে ভালোবাসতেন। রবিবারও তাঁর জন্য মাংস রান্না করেছিলেন মা। সোমবার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল ফ্রিজেই পড়ে আছে মাংসের বাটি।
ফ্রিজে পড়ে আছে একটা চকোলেটও। বোন আবদার করেছিল বলে শনিবারই সেটি এনে দিয়েছিলেন রবিউল। ফ্রিজ খুলে সেই ক্যাডবেরি দেখিয়ে সতেরো বছরের সাবিনা খাতুন হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘দাদার দেওয়া ক্যাডবেরি খাওয়া হলো না।’ রবিউলের দাদু বৃদ্ধ নুর মহম্মদ বলেন, ‘আমার মেয়ের বেঁচে থাকাই এখন কষ্টসাধ্য। ছেলেটাই ওদের ভরসা ছিল। কী করে যে দু-মুঠো ভাত আমার মেয়ে আর নাতনির মুখে তুলে দেব তা ভেবে কুল পাচ্ছি না।’