পুরাণকথা অনুসারে বলা হয়, রাজা সুরথই পৃথিবীতে প্রথম দেবী দুর্গার পুজো করেন। এই নিয়ে একটি আখ্যান আছে। চন্দ্রবংশীয় সুরথ ছিলেন একজন সুশাসক রাজা। কোনও এক যুদ্ধে শত্রুদের কাছে পরাজিত হয়ে বনে চলে যান। তাঁর দুরাবস্থার সুযোগে তাঁরই অমাত্যরা রাজার ধনসম্পদ ও রাজ্য অধিকার করে নেয়। বনে ভ্রমণ করতে করতে রাজা সুরথ তপোবনে এসে মেধা ঋষির আশ্রমে এসে উঠলেন। আশ্রমের জীবন-যাপন অন্য রকম, সেখানে সাংসারিক চিন্তা স্থান পায় না। কিন্তু সেখানেও হৃতরাজ্যের ভালমন্দের চিন্তায় রাজা শঙ্কিত হতে থাকতেন।
ওই সময়ে সমাধি নামক এক বৈশ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল রাজার। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে জানলেন, অসাধু স্ত্রীপুত্রেরা সেই বৈশ্যের সর্বস্ব অধিকার করে তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। নিজের গৃহ থেকে নিজেরই পরিজনদের দ্বারা প্রতারিত হলেও, ওই বৈশ্যও রাজার মতোই তাঁর পরিবারবর্গের শুভাশুভ আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন! এমন অবস্থায় উভয়ের মনেই প্রশ্ন জাগল, যাঁরা তাঁদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পথের ভিক্ষুক করে তুলছে, তাঁদের প্রতি ক্রুদ্ধ না হয়ে উলটে কেন হৃদয়ে অনুকম্পার উদয় হচ্ছে।
তাঁরা দুজনে তখন মেধা ঋষির কাছে গিয়ে এর উত্তর জানতে চাইলেন। ঋষি তখন এক এক করে চণ্ডীর দেবীমাহাত্ম্য সংক্রান্ত কাহিনিগুলোর উল্লেখ করে বললেন যে, পরমেশ্বরী শক্তি মহামায়ার প্রভাবেই এমন হচ্ছে। ঋষির কাহিনি শুনে অনুপ্রাণিত রাজা ও বৈশ্য নদীতীরে তিন বছর কঠোর তপস্যা করলেন এবং সব শেষে দুর্গোৎসব করলেন। তবে রাজা সুরথ ওই পুজো করেন বসন্তকালে, শরৎকালে নয়। দেবীর বরে রাজা সুরথ হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন ও সমাধি বৈশ্য তত্ত্বজ্ঞান লাভ করলেন।
দুর্গা সম্পর্কিত অন্যান্য কাহিনিগুলির মধ্যে মহিষাসুরের কাহিনিই সব থেকে বেশি প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। এই কাহিনিতে বলা হয়েছে—
বহু প্রাচীনকালে কোনও এক সময়ে মহিষাসুর নামে এক প্রবল পরাক্রমশালী অসুর একশো বছর ধরে চলে আসা এক যুদ্ধে দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন। দেবতারা তখন ব্রহ্মা, শিব ও নারায়ণের কাছে উপস্থিত হলেন। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। ওই ক্রোধ থেকে বিষ্ণু, শিব ও ব্রহ্মার চোখ দিয়ে একে একে মহাতেজ নির্গত হতে লাগল।
সেই সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্র-সহ অন্যান্য দেবতাদের চোখ থেকেও বিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। হিমালয়ে শীর্ষে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তিতে রূপান্তরিত হল। দেব-নরের দুর্গতি নাশ করবার জন্য তাঁর জন্ম বলে, দেবীর নাম হল দুর্গা। আবার ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামেও অভিহিতা হলেন।
হিমালয় দেবীকে দিলেন তাঁর বাহন সিংহ। আর প্রত্যেক দেবতা তাঁদের নিজের নিজের শ্রেষ্ঠ আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। এই দেবীই দশভূজা দুর্গা রূপে মহিষরূপী অসুর মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। দেবীর হুঙ্কারে ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কম্পিত হতে লাগল। আর সেই প্রবল চিৎকারে মহিষাসুর ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। কিন্তু দেবী দুর্গা ও তাঁর বাহন সিংহের প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করে একে একে সকলেই পরাজিত হল।
একে বারে শেষ পর্বে মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন। যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ করতে করতে মহিষাসুর নানা রকম রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত এবং মোহিত করার চেষ্টা করতে থাকলেন, কিন্তু দেবী দুর্গা মহিষাসুরের সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করতে লাগলেন।
দেবী দুর্গা তখন লাফ দিয়ে মহিষাসুরের কাঁধের উপর চড়ে তাঁর বুকে শূল বসিয়ে করে তাকে বধ করলেন। মহিষাসুরের ওই পরিণতি দেখে বাকি অসুরসেনারা ভয়ে পালিয়ে গেল। সেই থেকে দেবতারা আবার স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন। পুরাণগ্রন্থের মতে, অমাবস্যার পরবর্তী শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন ওই দেবীকে পুজো করেন। দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন। সেই জন্য ওই দশমী তিথিকে বিজয়া দশমী বলা হয়।