খবরটা যখন বছর ২৪-এর বধূর কাছে এসে পৌঁছল, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বৃহস্পতিবারই শুনেছিলেন, তাঁর পাচারকারীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে দু’জনের যে ১০ বছরের জেল হবে ও অন্য জনের ৭ বছর, তা ভাবতেও পারেননি। ‘এই সময়’কে বললেন, ‘উকিলবাবু (স্পেশাল পিপি দেবরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়) মামলা চলাকালীনই ভরসা দিয়েছিলেন যে, শাস্তি হবেই। কিন্তু আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজ খুব খুব আনন্দ হচ্ছে। এত দিনে শান্তি।’
শুক্রবার ডায়মন্ড হারবারের ফাস্ট ট্র্যাক ৩ নম্বর কোর্ট মানবপাচারে দোষী সাব্যস্ত পিঙ্কি, মীনা সিং ও ফারাক আলি গায়েন ওরফে রাকেশ মণ্ডলের শাস্তির মেয়াদ ঘোষণা করে। বিচারক চন্দ্রপ্রভা চক্রবর্তী মীনাকে ও ফারাককে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা করেছেন। পিঙ্কির হয়েছে ৭ বছরের জেল ও জরিমানা। শুধু আইপিসি ৩৭০ (মানবপাচার), ১২০বি (ষড়যন্ত্র)-সহ একাধিক ধারাতেই নয়, ইমমর্যাল ট্র্যাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্টের (আইটিপিএ) ৬বি ধারাতেও এদের শাস্তি ঘোষণা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, আইটিপিএ-তে খুব বেশি শাস্তির নজির নেই এই রাজ্যে, আর ১০ বছর সাজাও কমই হয়েছে। আইনজ্ঞদের একাংশ বলছেন, পাচারে ৭-৮ বছরের বেশি জেল তেমন হয় না। সে দিক দিয়ে এই রায় দৃষ্টান্তমূলক।’ এই রায় ভীষণ খুশি এই মামলার তদন্তকারী অফিসার প্রবীর বল। তাঁর থেকেই ফোনে জানা গেল উদ্ধার-অভিযানের কাহিনি।
জানালেন, পাচার হওয়া তরুণী খদ্দেরের মোবাইল থেকে ফোন করে বাড়িতে বলেছিলেন, ‘নম্বরটা পুলিশকে দিও। আমি বিপদে আছি।’ সেই নম্বর ধরে টাওয়ার ট্র্যাক করে লোকেশন বের করা হয়। চিহ্নিত করা হয় সেই খদ্দেরকে। প্রবীরের কথায়, ‘প্রথমে ওই লোকটিকে খুঁজে বের করাই ছিল লক্ষ্য। কারণ, তাঁর থেকেই পাওয়া যাবে অনেক সূত্র। তিনি আমাদের সাহায্যে রাজি হন।’
তাঁকে নিয়ে আগ্রা পৌঁছন প্রবীরের নেতৃত্বে সুন্দরবন পুলিশ জেলার দল। সঙ্গে ছিল দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশেরও টিমও। প্রবীরের কথায়, ‘যে জায়গাটায় ওই খদ্দের নিয়ে গেলেন, সেটা যে যৌনপল্লি, বোঝার উপায় ছিল না। নীচে বড় বড় দোকান। ঝলমলে পরিবেশ। দোতলায় চলে যৌন-ব্যবসা! সেখানে অপরিচিত কেউ আবার ঢুকতে পারে না।’ আগে ঢুকলেন সেই খদ্দের। তাঁকে দেখে মীনা এগিয়ে এল। তার গায়ে ১৫ ভরি সোনার গয়না।
তাকে ওই খদ্দের বললেন, ‘তিনটে নতুন কাস্টমার আছে।’ মীনা গদগদ। সাধারণ পোশাকে প্রবীর ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বাকি দু’জন ঢুকলেন ভিতরে। কিন্তু যাঁর জন্যে আসা, সে কই? এই সময়েই মীনা এগিয়ে দেয় ওই যৌনপল্লির মেয়েদের ছবির ক্যাটালগ। প্রবীরের কথায়, ‘ক্যাটালগে ছবি দেখে চিনতেই পারিনি মেয়েটিকে। ভোলবদলে দেওয়া হয়েছিল অষ্টাদশীর। তাও আন্দাজ করে বাছলাম।’ নির্ভুল ছিল আন্দাজ।
এই মেয়েটির খোঁজেই তো আসা। কিন্তু প্রবীর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। শব্দ পেয়ে অন্য দু’জনও। ততক্ষণে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে দিল্লি ও লখনৌ পুলিশ। মীনা বুঝতে পেরে যায় বিপদ। প্রবীরের কথায়, ‘দেখি একটা বাচ্চা নেপালি মেয়ে ঘরগুলোয় তালা লাগাচ্ছে, যাতে কোনও মেয়েকে বার করা না-যায়। আর লক সিস্টেম একেবারে ভল্টের মতো।’
প্রবীর মেয়েটির থেকে চাবি চাইতেই মীনার দুই নেপালি দেহরক্ষী কুকরি দিয়ে তাঁকে মারতে আসে। পালটা অস্ত্র বের করেন প্রবীরও। অবশেষে হাতে চাবি পান। শেষে ৬টি মেয়েকে নিয়ে ফেরে পুলিশের দল। একে একে গ্রেপ্তার হয় মীনা, পিঙ্কি ও ফারাক। এখন সেই পাচার হওয়া তরুণীর সুখের সংসার। রয়েছে ছোট্ট সন্তান। বললেন, ‘আমরা গরিব, তাই টাকা, বাড়ি করে দেওয়ার টোপ দিয়েছিল পাচারকারীর সঙ্গীরা। তবে আমি বলেছিলাম, মামলা তুলব না।’
সুন্দরবনের তৎকালীন এসপি তথাগত বসুর কথায়, ‘উদ্ধারেই তো কাজ শেষ হয় না। ওই তরুণী এখন ভালো আছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যে ৬ জন উদ্ধার হয়েছিলেন, কেউ-ই রি-ট্র্যাফিকড হননি।’ দেবরঞ্জনের কথায়, ‘পাচারের মতো অপরাধ যত প্রমাণ করা যাবে, তাতে পাচারকারীরা ভয় পাবে। মানুষও সচেতন হবেন।’ শক্তিবাহিনীও এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সংস্থার পক্ষে ঋষিকান্ত বলেন, ‘পুলিশ ও পিপি-কে ধন্যবাদ।’ তবে সুন্দরবনে পাচার-চিত্র বিশেষ বদলায়নি। সেটার বদল আশু জরুরি।