কালো রঙের একটি স্কার্ট। তাতে খোদাই করা একটি বারকোড। এই সামান্য সূত্র থেকেই কিনারা হয়ে গেল দেরাদুনে খুন হওয়া শিলিগুড়ির এক বার ডান্সারের হত্যা রহস্যের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামেন্দু উপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করার পরে আদালতে জমা দেওয়া রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখ করেছে দেরাদুনের রাজপুর থানার পুলিশ। তাতে বলা হয়েছে, ধৃত আর্মি কর্তা জেরায় নিজের অপরাধ কবুল শুধু করেননি, কেন এই খুন করেছেন তারও বিস্তারিত বয়ান দিয়েছেন। গত ৯ তারিখ রাতে এই খুনের ঘটনা ঘটে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মৃত বার ডান্সার শ্রেয়া শর্মা(২৫) ওরফে সুমিত্রা আদতে নেপালের তানহু জেলার বাসিন্দা। লকডাউনের পরে পরিবারে আর্থিক সঙ্কট হওয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে তিনি শিলিগুড়িতে চলে আসেন। কাজ নেন সেভক রোডের একটি বারে। এদিকে, উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা লেফটেনান্ট রামেন্দু ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বদলি হয়ে শিলিগুড়ি যান। কোনও এক রাতে মদ্যপান করার জন্য তিনি ওই বারে গিয়ে শ্রেয়ার নাচে মুগ্ধ হয়ে যান। টিপস হিসেবে বেশ ভালো টাকা খরচও করেন।
প্রথম দর্শনেই নর্তকীর প্রেমে পড়ে যান তিনি। ঘনঘন যাতায়াত বেড়ে যায় ওই বারে। মাসখানেকের মধ্যে শ্রেয়ার সঙ্গে লিভ টুগেদার করতে শুরু করেন আর্মি অফিসার। উত্তরপ্রদেশে পড়ে থাকেন তাঁর স্ত্রী এবং দুবছরের সন্তান। এরপর অন্য পাঁচটি লাভ স্টোরির মতো প্রায় একই চিত্রনাট্য ধরে এগিয়ে চলে তাঁদের ভালোবাসার গল্প। বছর খানেক আগে আচমকা দেরাদুনের ক্লেমেন্ট টাউন ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড হয়ে যান রামেন্দু। কিন্তু তাঁকে ছেড়ে থাকতে রাজি ছিলেন না শ্রেয়া।
সংসার বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দূরে দেরাদুনে প্রেমিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম কয়েকদিন প্রেমিকাকে স্থানীয় একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেন রামেন্দু। তারপর একটি ঘর ভাড়া করে দেন। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশ থেকে লেফটেনান্টের পরিবার চলে আসে দেরাদুনে। এদিকে, বিয়ের জন্য চাপ বাড়াতে শুরু করেন শ্রেয়াও। দু’দিক ব্যালান্স করে চলছিলেন সেনা অফিসার। কিন্তু, একদিন স্ত্রীর কাছে চ্যাট-ফাঁস হয়ে যায় তাঁর। যা নিয়ে শুরু হয় প্রবল ঝামেলা। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন প্রেমিককেই সরিয়ে ফেলার।
কীভাবে খুন?
উত্তরাখন্ড পুলিশের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ধৃত সেনা অফিসার জেরায় জানিয়েছেন, শ্রেয়া তাঁকে বিয়ের জন্য বারবার চাপ দিলেও দ্বিতীয়বার তাঁর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। এ নিয়েই দু’জনের মধ্যে ঝামেলা হতো। গত ৯ তারিখ রাতে শ্রেয়াকে তিনি প্রথমে নিয়ে যান দেরাদুনের রাজপুর রোডের একটি ক্লাবে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে দুজন মদ্যপান করেন। এরপর প্রেমিকাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাওয়ার নাম করে গাড়িতে তোলেন রামেন্দু। রাজিও হয়ে যান শ্রেয়াও। রাত দেড়টা নাগাদ থানো রোডে গাড়ি পৌঁছনোর পরে নির্জন জায়গা দেখে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করেন সেনা কর্তা।
সেখানেই গাড়িতে আগে থেকে রেখে দেওয়া হাতুড়ি দিয়ে শ্রেয়ার মাথায় বারবার ঘা মারতে থাকেন। শেষে টয়লেট ক্লিনার ঢেলে দেন মুখে। শেষে দেহটি রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে ফেলে দেন তিনি। গত সোমবার সকালে দেহটি নজরে আসে পুলিশের। এরপর মৃতার পোশাকের বারকোড ধরে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। দেখা যায় সেটি জ়ুডিও ব্রান্ডের। ওই এলাকায় মাত্র দুটি দোকানে সেই ব্রান্ডের পোশাক বিক্রি হয়।
তদন্তকারীরা সেখানে খোঁজ নিতেই জানা যায়, দোকানগুলি থেকে একমাসের মধ্যে মোট ৮টি ওই ধরনের পোশাক বিক্রি হয়েছে। ওই বারকোডে নির্দিষ্ট দোকান, কেনার তারিখ এবং সময়ও জানা যায়। এবার পুলিশ দোকান এবং তার আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু করতেই মৃত তরুণীর মতো দেখতে একজনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। দেখা যায়, একটি এসইউভি গাড়িতে এক ব্যক্তির সঙ্গে ওই তরুণী পোশাক কিনে ফিরে যাচ্ছেন। ঠিক ওই গাড়িটিরই উইন্ড স্কিনের উপর আবার ছোট লাল হরফে লেখা রয়েছে ‘আর্মি।’
পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ক্লু মেলার পরে তদন্তকারীরা দেরাদুন থেকে সিরওয়ালগড়ে যাওয়ার রাস্তার প্রায় পৌনে চারশো সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখে সেই রাতে যাতায়াত করা প্রায় আড়াইশো গাড়িকে ভাবে চিহ্নিত করেন। এরপর সন্দেহভাজন ২০টি গাড়িকে বাছা হয়। ওই বারকোড থেকে সূত্র পেয়ে আর্মি লেখা যে গাড়িটির নম্বর পাওয়া গিয়েছিল তার হদিশ মেলে চিহ্নিত ২০টি গাড়ির মধ্যে। আর এখান থেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে স্থানীয় পণ্ডিত্বারী প্রেমনগরের বাড়ি থেকে তুলে আনা হয় লেফটেনান্ট কর্নেলকে। খুনের ঘটনা কবুল করে নেওয়া ছাড়া এরপর তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না।