যাদবপুরে র্যাগিং ও ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর শাশ্বতীকে কমিটির শীর্ষে বসান রাজ্যপাল-নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ। শাশ্বতী এবং তাঁর কমিটির দায়িত্ব ছিল, র্যাগিং ঠেকাতে প্রথম বর্ষ এবং অন্য পড়ুয়াদের আলাদা আলাদা হস্টেলে কোথায় কী ভাবে রাখা যায়, তা ঠিক করার। তাঁর এমন আচমকা অনাস্থা প্রকাশে ভিসির তৈরি সেই কমিটিই কার্যত প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল বলে অনেকে মনে করছেন। পাশাপাশি কাঠগড়ায় উঠল কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও।
শাশ্বতীর অভিযোগ, তাঁর কাজে পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে র্যাগিং নির্মূল করার উপায় থাকবে না। তাঁর দাবি, এই উপায় যাতে না বেরোয়, তারই চেষ্টা করছেন কর্তৃপক্ষ, ছাত্র এবং শিক্ষকদের একাংশ। শাশ্বতীর বক্তব্য, অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট-সহ বাকিদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গিয়েছে, কেবল ফার্স্ট ইয়ারের পড়ুয়াদেরই র্যাগ করা হয় না। সেকেন্ড ইয়ারও সমান ভুক্তভোগী। এ জন্য তিনি আলাদা আলাদা বর্ষের পড়ুয়াদের জন্য পৃথক হস্টেল চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেই বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
পদত্যাগ পত্রে শাশ্বতী লিখেছেন — ‘ওই প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার মৃত্যুর নেপথ্যে রয়েছে সিস্টেম্যাটিক র্যাগিং। সামগ্রিক ভাবে এর বদল ঘটানো না গেলে এবং দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়াদেরও রক্ষা করা না গেলে, কোনও পরিবর্তনই হবে না। আমি আমার হাতে রক্তের দাগ লাগতে দেব না।’ এ প্রসঙ্গে ভিসি বুদ্ধদেবের বক্তব্য, ‘উনি ভালো কাজ করছিলেন। এ ভাবে কেন পদত্যাগ করলেন, আলোচনা করে দেখছি।’
এ সবের মধ্যে বুধবারই আবার রাজ্য সরকারের তৈরি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্তা-অফিসার, হস্টেল সুপারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে বলে সূত্রের খবর।
শাশ্বতী একা নন। ভারপ্রাপ্ত ভিসি তথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন মৃত ছাত্রের বাবাও। তিনি বুধবার বলেন, ‘প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকার ঠিক উল্টো ছবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসছে। সব বিষয়েই ওঁরা যেন গা ছাড়া। এতদিন হয়ে গেল, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বা র্যাগিং ঠেকাতে বাকি পদক্ষেপ কিছুই করা হচ্ছে না। এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের কাছে আবেদন জানাব। তার আগে আইনি পরামর্শ নিচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্টের নানা সুপারিশ নিয়ে ভিসি একদিন আগেই বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি এমনও দাবি করেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনই ইসিতে পেশ করা হবে না। আগে তা অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড এবং কমিটির বৈঠকে আলোচনা হবে। বুধবার অবশ্য তাঁর যুক্তি, ‘আমি কখনও বলছি না যে তদন্ত কমিটির কোনও বৈধতা নেই বা তারা যে তদন্ত করেছেন, তা নিয়ে কোনও অভিযোগ আমি পেয়েছি।
তবে কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড ও কমিটি থাকতে ফের কেন একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করা হয়েছে? সে প্রশ্নের নিরসনের জন্যই অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াডকে রিপোর্ট পড়ে দেখার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।’ যদিও শিক্ষক সংগঠন জুটার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করে বলেন, ‘ইচ্ছে করে ওই দিনের ঘটনার তদন্তের সঙ্গে অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির তদন্তকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, যাতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ কার্যকর না করতে হয়। এবং দোষীরা আড়ালে থাকতে পারে।’
বুদ্ধদেবের যুক্তি মানতে নারাজ ইউজিসি-ও। ইউজিসি সূত্রে খবর, গত ১০ অগস্ট যখন ছাত্রমৃত্যুর পর ওই অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি তৈরি করা হয়, তখন র্যাগিংয়ের প্রাথমিক কোনও অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যায়নি। মৃত ছাত্রের মামা ভাগ্নের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। সে প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। পরে র্যাগিংয়ের অভিযোগ স্পষ্ট হলে ইউজিসি বারবার জানিয়েছে, সে সময়ে কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি ও স্কোয়াড সুগঠিত ছিল না। অনেক সদস্যই ছিলেন না তাতে। ফলে ওই আধা গঠিত কমিটি বা স্কোয়াড কোনও তদন্ত শুরু করলে আইনি জটিলতা হতে পারত।
ইউজিসি-র সদস্যরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখনও কেউ কেউ এই তদন্ত কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সূত্রের দাবি, ইউজিসি-র বেশির ভাগ সদস্যকেই ভারপ্রাপ্ত ভিসি-সহ বাকিরা বোঝান, আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই ভরসা রাখতে হবে। দ্রুত অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি ও স্কোয়াড গঠন করা হবে। ইউজিসি-র চাপের মুখে সেই কমিটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে গত সপ্তাহে।
আর বুধবার নতুন করে তৈরি হয়েছে স্কোয়াড-ও। আগে যেখানে স্কোয়াডে ১৫ জন সদস্য ছিল, এ দিন সেখানেই ৫৫ জনকে আনা হয়েছে। কিন্তু ইউজিসি সূত্রের দাবি, এখনও অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত কোনও রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পাঠানো হয়নি। দ্রুত এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। বুদ্ধদেবের বক্তব্য, ‘আমরা এই সব কিছু নিয়েই কাজ করছি। এত বড় একটা রিপোর্ট। এত বড় ঘটনা। এতজনকে শাস্তির সুপারিশ। তাই কোনও কিছু কনফার্ম করার আগে আমাদের আরও একবার রিভিউ করতে আপত্তি কোথায়! সে কাজটাই আপাতত স্কোয়াড করবে।’