জঙ্গলে টহলদারি সেরে সোমবার সন্ধেবেলা টলতে টলতে পিলখানায় ফিরেছিল রোহিণী। জলদাপাড়ার কুনকিটিকে দেখেই মালুম হচ্ছিল, কোনও রকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে এসেছে সে। মাহুত জুয়েল খড়িয়া পিলখানায় পৌঁছে খবর দেন, গোখরো সাপে কেটেছে রোহিণীকে। বাঁ পায়ে ছোবল খেয়ে বিষধরকে পিষে মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় বন দফতরের পোষা কুনকি হাতিটি।
বিষের প্রভাব শরীর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে মাহুতকে নিয়ে সেই অবস্থাতেই কোনও রকমে এসে পৌঁছয় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের চিলাপাতা রেঞ্জের মেন্দাবাড়ি বিটের পিলখানায়। ততক্ষণে রোহিণীর শরীরে একে একে সর্প দংশনের সব ধরনের উপসর্গ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছিল সে। ঘুম জাঁকিয়ে বসছিল তার দুই চোখে।
গোখরোর বিষ স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে। ঘুমিয়ে পড়া এক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হতে পারে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় মাহুত জুয়েল রোহিণীর পিঠ ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য নামেননি। বরং চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, যাতে রোহিণীকে জাগিয়ে রাখা যায়। খবর পেয়ে ওই রাতেই মেন্দাবাড়িতে ছুটে আসেন জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণী চিকিৎসক উৎপল শর্মা, সহকারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষক নভোজিৎ দে ও ডিএফও সন্দীপ বেরওয়াল-সহ অন্য বনাধিকারিকরা।
চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি ভেনম সিরামের খোঁজ শুরু হয়। কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে বনকর্তারা ছুটে যান বীরপাড়া রাজ্য সাধারণ হাসপাতাল, আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল, কোচবিহার ও ফালাকাটা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। রাত আটটা নাগাদ প্রথমে চারটি এভিএস অ্যাম্পুল এসে পৌঁছয় ফালাকাটা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে। হাতির কানের পিছনের অংশে স্যালাইনের মাধ্যমে এভিএস দেওয়া হয়।
রাত যত বাড়তে থাকে, বিষের প্রভাবে কাহিল রোহিণীর আচ্ছন্নতা তত জাঁকিয়ে বসতে থাকে। তাকে জাগিয়ে রাখাই তখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সবাই ঘিরে থাকেন রোহিণীকে। তবে মূল দায়িত্ব বর্তায় মাহুত জুয়েল খড়িয়ার উপরেই। সারারাত ঠায় রোহিণীর পিঠে বসে এভিএস স্যালাইনের বোতল হাতে ধরে রাখেন তিনি। আর নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখেন রোহিণীকে। কোনও ভাবেই যাতে রোহিণী ঘুমিয়ে না পড়ে, সেটাই তো চ্যালেঞ্জ!
উৎপল শর্মা বলেন, ‘গোখরো সাপের দংশনে জলদাপাড়ায় আমার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। কয়েক বছর আগে রাজকুমারী নামের একটি হাতিকে গোখরো ছোবল দেওয়ার পর তাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। তবে সাপের বিষের প্রভাবে যে যে লক্ষ্মণ দেখা গিয়েছিল, তার থেকে রোহিণী এখন অনেকটাই মুক্ত বলা যায়। এখনও পর্যন্ত ১০ অ্যাম্পুল এভিএস ওকে দেওয়া হয়েছে।
খাবারে অরুচি থাকলেও দেওয়া হয়েছে প্রচুর পরিমাণে আখ ও ওআরএস। এরপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ডায়েরিয়া ও মুখে ঘা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আখ ছাড়া রোহিণীর অন্যান্য খাবার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরে হাতিটির স্বাভাবিক রুচি ফিরে এসেছে। যা খুবই ভালো লক্ষ্মণ। রোহিণী যে সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত, তা বলার সময় আসেনি। তবে আমরা আশাবাদী, তাই হাল ছাড়ছি না।’
উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রাণ শাখার মুখ্য বনপাল রাজেন্দ্র জাখর জানালেন, ‘বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রোহিণীর জীবন বাঁচাতে অ্যান্টি ভেনম সিরামের খোঁজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। স্বাস্থ্য দপ্তরও আমাদের বিপদে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আশা করছি, রোহিণী আজ থেকে নতুন জীবনে পা রাখল। বেশ কিছুদিন ওকে বিশ্রামে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হবে।’
মঙ্গলবারও রোহিণীর দু’চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। যন্ত্রণায় ডুকরে উঠেছে মাঝেমধ্যেই। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঈশ্বরের নাম জপ করে চলেছেন মাহুত জুয়েল খড়িয়া। বললেন, ‘ও বেঁচে গেলে আমার সব পরিশ্রম সার্থক হবে।’
প্রতি মুহূর্তের ব্রেকিং নিউজ, আপডেট, বিশ্লেষণ এবং ভিডিয়ো দেখতে ফলো করুন এই সময় ডিজিটাল চ্যানেল। ক্লিক: https://whatsapp.com/channel/0029Va9zh58Gk1Fko2WtDl1A