সেটা ছিল নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক। তৃণমূল সুপ্রিমোর বরাবরের পছন্দ এবং ভরসার আর এক নাম বালু। তৃণমূলের পুরোনো দিনের নেতারা বলেন, ‘দিদির দুঃসময়ে হাতেগোনা যে ক’জন নেতা কালীঘাটে যেতেন, বালু তাঁদের অন্যতম।’ সেই বালুর কাছের লোকেদের দাবি, মন্ত্রী হওয়ার পরে পুরোনো সঙ্গীদের থেকে দূরত্ব বাড়ানোটাই তাঁর কাল হলো।
আদতে পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের বাসিন্দা জ্যোতিপ্রিয়র পরিবার। তবে ব্যবসার জন্য দীর্ঘদিন কলকাতা নিবাসী। স্কটিশ চার্চ স্কুলের ছাত্র, পরে আইন নিয়ে পড়াশোনা বালুর। অশোক দেবের হাতে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৮৪ সালে মমতা যখন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়েন, বালু তখন থেকেই তাঁর অনুগামী। বেলেঘাটা কানেক্টর লাগোয়া সল্টলেকের ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভাঙচুরের পর থেকেই রাতারাতি প্রচারে চলে আসেন তিনি।
মমতা উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর দায়িত্ব দেওয়ার পরে জ্যোতিপ্রিয় পাখির চোখ করেছিলেন গাইঘাটা বিধানসভাকে। ২০০০-এর বন্যায় নিজের উদ্যোগে লরি-ভর্তি ত্রাণ আর লোকলস্কর নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন গাইঘাটা-ঠাকুরনগরের দুর্গত এলাকায়। বাম জমানায় সরকারি ত্রাণ পৌঁছনোর আগেই নিজের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ২০০১-এ ওই এলাকায় তৃণমূলের টিকিটের দাবিদার ছিলেন অনেকেই।
একবারও ভোটে না লড়া বালু দরবার করেননি। মমতা দিল্লি যাওয়ার সময়ে টিকিটের জন্য বিমানবন্দরেও পৌঁছে গিয়েছিলেন জনাদুই হেভিওয়েট নেতা। মমতা প্রকাশ্যেই তাঁদের বলেন, ‘গাইঘাটার টিকিট আমি বালু ছাড়া আর কাউকে দেবো না।’ সেই শুরু। ধাপে ধাপে উত্তর ২৪ পরগনার দলের জেলা সভাপতি, পর্যবেক্ষক হয়েছেন। ২০০৬-এর বিধানসভায় তৃণমূল খারাপ ফল করলেও বালু জিতে যান।
সেই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে দলের মুখও হয়ে ওঠেন। চাইলেই নাগালে পাওয়া, রাতবিরেতে ফোনে মেলা, দলের লোকেরা বিপদে পড়লে ছুটে যাওয়া—এটাই বালুর ইউএসপি। মমতার কাছের বৃত্তে থাকলেও কখনও সেটা দেখনদারির পর্যায়ে নিয়ে যাননি। পরিচিত-অপরিচিত কেউ তাঁর বাড়ি বা অফিসে গেলে না খাইয়ে ছাড়েন না। সল্টলেকের বাড়ির সকালের দরবারে কচুরি-তরকারি তো রোজকার বরাদ্দ।
২০১১-এ সংরক্ষণের জন্য গাইঘাটা ছেড়ে হাবরা কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়েন। খাদ্য ও সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর তাঁকে দেন মুখ্যমন্ত্রী। পরপর দু’বার একই দফতর তাঁর হাতে ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কি আদৌ কোনও ভিত্তি রয়েছে? থাকলে তার সূত্রপাতই বা কোথায়? সে সব প্রমাণসাপেক্ষ এবং বিচারাধীন। তবে জ্যোতিপ্রিয়র ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, খাদ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই নিজের দীর্ঘদিনের বন্ধু হাওড়ার অভিজিৎ দাসকে আপ্তসহায়ক করেন।
তার পরেই নাকি কিছুটা ছন্দপতন। অফিসের কাজ যেমন দেখতেন অভিজিৎ, তেমন জেলায় তাঁর আপ্ত সহায়ক ছিলেন দত্তপুকুরের এক নেতা। বছরখানেকের মাথায় দত্তপুকুরের সেই নেতাকে সরিয়ে দেন। বছরতিনেক কাটতে না কাটতে বাদ পড়েন অভিজিৎও। তার পরেই আপ্তসহায়ক হিসেবে এন্ট্রি অমিত দে ওরফে মনার। বালু ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে যাঁদের বালুর সুখে-দুঃখে দেখা যেত, ধীরে ধীরে তাঁরা কী ভাবে যেন দূরে চলে গেলেন। এই সময়ে মন্ত্রীর চোখের আড়ালে নাকি অনেক কিছুই ঘটেছে। তবে সে সবের কোনও ভিত্তি রয়েছে কি না, তা সময়ই বলবে।