কোম্পানি টু লোন- নিখুঁত পরিকল্পনা
আদালতে জমা দেওয়া ইডি আধিকারিকদের নথি বলছে, রেশন বন্টনের নামে দুর্নীতি হচ্ছে, তা জানতেন বাকিবুর। এমনকী, তাঁর আশঙ্কাও ছিল, যে কোনও দিন তদন্তের আওতায় চলে আসতে পারে তাঁর ‘এনপিজি রাইস মিল প্রাইভেট লিমিটেড’। কয়েক বছর আগে সেই অনুমান মিলেও যায়। রাজ্য পুলিশ রেশন বন্টন দুর্নীতির তদন্তে নেমে বেশ কয়েকজন ডিস্ট্রিবিউটরকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বাকিবুরকে ধরা হয়নি। কেন তা হয়নি, এখন সেই উত্তর খুঁজছে ইডি।
তদন্তে উঠে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে গম থেকে আটা ভাঙিয়ে দেওয়ার সরকারি বরাত পেয়েছিলেন বাকিবুর। সেখান থেকেই দুর্নীতির সূত্রপাত। এই অসাধু চক্রে ডিস্ট্রিবিউটর থেকে শুরু করে তৎকালীন খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরও ভূমিকা ছিল বলে ইডি আদালতে জানিয়েছে। যদিও মন্ত্রীকে ইডি হেফাজতে নেওয়ার যুক্তি রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বিচারক।
ব্যাঙ্কশাল আদালতে নথি পেশ করে ইডি দাবি করেছে, শ্রী হনুমান রিয়েলকন প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ইনোভেটিভ প্রাইভেট লিমিটেড এবং গ্রেসিয়াস ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড খোলা হয়েছিল টাকা সরাতে। এবং তা হয়েছিল জ্যোতিপ্রিয় এবং বাকিবুরের যোগসাজশে। ওই কোম্পানি খুলে জ্যোতিপ্রিয়র স্ত্রী মণিদীপা এবং প্রিয়দর্শীনিকে প্রথমে ডিরেক্টর করা হয়। সেই কোম্পানিতে ১২ কোটি ৬ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল বলেও দেখানো হয়। তবে বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি।
ইডি-র দাবি, ২০২২ সালে ওই সংস্থাগুলির সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে ২০ কোটি ২৪ লক্ষ ১৬ হাজার ১৯৪ টাকা ওঠে। সেই টাকা বাঁকুড়ার ২টি পার্টনারশিপ ফার্ম এম/এস এজে অ্যাগ্রোটেক এবং এম/এস রয়্যাল অ্যান্ড কোম্পানিতে ট্রান্সফার করা হয়। পরে বাকিবুরের শ্যালক অভিষেক বিশ্বাসের নামে থাকা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়ে। আদালতে ইডি-র অভিযোগ, বাকিবুর বয়ানে জানিয়েছেন, পরবর্তী ক্ষেত্রে ঋণ হিসেবে সেই টাকা জ্যোতিপ্রিয়র কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ঋণ গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত শোধ করেননি মন্ত্রী। সে কারণেই বালুকে(মন্ত্রীর ডাকনাম) রাজ্যের একজন ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব’ বলেও নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আপত্তি কমান্ড হাসপাতালের
রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আপাতত ইএম বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সুস্থ হলে আলিপুরের কমান্ড হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁর মেডিক্যাল টেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিএমএম বিচারক। এদিন বাকিবুর রহমানের মামলা সংক্রান্ত শুনানিতে ইডি-র তদন্তকারী অফিসারের উদ্দেশে বিচারক জানতে চান, ‘উনি (জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক) এখন কেমন আছেন? কোথায় আছেন?’ এর পর তদন্তকারী অফিসারেরা মন্ত্রীর স্বাস্থ্যের আপডেট জানান। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তিনি আপাতত স্থিতিশীল। হাই সুগার, কিডনির অসুখ, ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা নিয়ে ভর্তি হওয়া মন্ত্রীর চিকিৎসা করছেন কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি এবং ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞরা। শুক্রবার আচমকা কেন তাঁর ব্ল্যাকআউট হলো, তার পিছনে হার্টের কোনও সমস্যা অথবা সার্ভাইকাল স্পন্ডিলাইটিস জাতীয় কোনও সমস্যা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছেন চিকিৎসকেরা।
জ্যোতিপ্রিয়কে ভর্তির বিষয়ে এদিন কমান্ড হাসপাতালের তরফে আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক অভিযুক্তকে। আমাদের উপর এমনিতে চিকিৎসার বোঝা চেপে রয়েছে। কমান্ড হাসপাতালে রোগী ভর্তির নির্দিষ্ট ক্যাটেগরি রয়েছে। সেনাবাহিনীর কর্মী এবং তাঁর পরিবারের জন্য এই হাসপাতাল। সীমান্তে যাঁরা দেশের সেবা করছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য আমরা দায়বদ্ধ। এ ক্ষেত্রে আগে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে (পার্থ চট্টোপাধ্যায়) এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওডিশা। এ বার অভিযুক্তকে অন্য কোথাও চিকিৎসা করা হোক।’ যদিও বিচারক কমান্ড হাসপাতালকে জানিয়ে দেন, ‘এই চেয়ার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অর্ডার আমি বদলাতে পারব না।’ সূত্রের খবর, এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কমান্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতেরও দ্বারস্থ হতে পারে।
মুখোমুখি প্রাক্তন-বর্তমান পিএ
শনিবার সকাল থেকেই সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক অভিজিৎ দাস এবং বর্তমান আপ্ত-সহায়ক অমিত দে-কে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। দু’জনেই জ্যোতিপ্রিয়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এমনকী, জ্যোতিপ্রিয়র ঘনিষ্ঠিদের সঙ্গেও দু’জনের ওঠা বসা রয়েছে। তা ছাড়া অনেক ডিস্ট্রিবিউটর মন্ত্রীর কাছে পৌঁছনোর আগে দুই আপ্ত সহায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করতেন অভিজিৎ এবং অমিত। সে কারণে তাঁদের বয়ান গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ইডি শুক্রবার জ্যোতিপ্রিয়কে আদালতে পেশ করে দাবি করেছিল, ‘বালুদা’ লেখা একটি মেরুন রঙের ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। তাতে টাকার হিসেবও লেখা রয়েছে। সেই ডায়েরি অভিজিতের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বলে এদিন ইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও এ বিষয়টি আগের দিন আদালতে স্পষ্ট করেনি ইডি। ওই ডায়েরির ভিত্তিতেই এদিন দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে জানা গিয়েছে। এর পাশাপাশি জ্যোতিপ্রিয়র স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়াও দ্রুত শুরু করতে চায় ইডি। সূত্রের খবর, ভুয়ো বা কাগুজে কোম্পানির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকা ১৬ কোটি টাকা খুব তাড়াতাড়ি ফ্রিজ করা হতে পারে।
বাকিবুরের মাথায় কার ‘আশীর্বাদ’?
যাঁর বয়ানের ভিত্তিতে বিপাকে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়, এদিন আদালতে সেই ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানের জামিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। এদিন ইডি-র আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, ‘রেশনের জন্য বরাদ্দ আটা খোলা বাজারে দেদার বিক্রি হয়েছে। এই ঘটনায় রাজ্য পুলিশ আগেই তদন্ত শুরু করেছিল। কিন্তু মিল মালিক বাকিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ, তাঁর মাথায় প্রভাবশালীর আশীর্বাদ ছিল।’ পাল্টা বাকিবুরের আইনজীবী বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার মক্কেল ডিস্ট্রিবিউটরদের আটা সাপ্লাই করতেন। এর পর, কী হয়েছে তা আমার মক্কেলের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ফলে তাঁকে জামিন দেওয়া হোক।’ অন্যদিকে, জামিনের বিরোধিতা করে ইডি আদালতকে জানায়, বাকিবুর জামিন পেলে প্রভাব খাটাতে পারেন। প্রমাণ নষ্ট করতে পারেন। দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শুনে বিচারক ধৃত ব্যবসায়ীকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন।