শ্রীকান্ত ঠাকুর: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, আর এই পার্বণের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই রয়েছে ধর্মীয় উৎসব। যেখানে মাটির তৈরি পূজার সামগ্রী ব্যবহারই রীতি-রেওয়াজ। পুজোর মরসুম শুরু হয় বিশ্বকর্মা পুজো দিয়ে, শেষ হয় সরস্বতী পুজোর মাধ্যমে। এর মাঝে পড়ে দুর্গাপুজো লক্ষ্মী পুজো কালী পুজো নবান্ন পৌষ পার্বণ। সবেতেই মাটির জিনিসপত্র ব্যবহারের রীতি। আর এই জন্যই বালুরঘাটের পরানপুর পালপাড়ার সহদেব পাল, মহাদেব পাল, মোহন পাল, বাসু পাল, মদন পালদের নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। দিনরাত এক করে বাড়ির সকলকে নিয়ে চলছে মাটির পুজোর সামগ্রী তৈরির কাজ।
আরও পড়ুন: Purba Bardhaman: দিনে-দুপুরে ‘জলদস্যু’! পুজোর আবহে দামোদরে মূর্তিমান আতঙ্ক…
অবশ্য আগের মতো এখন আর কালীপুজোর আগেই শুধু প্রদীপ তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন না তাঁরা। তাঁরা এখন প্রদীপের পাশাপাশি ধুনুচি, হাঁড়ি পিলসুজ এইসবও তৈরি করেন। আগে মাটির প্রদীপের চাহিদা ছিল। এখন ততটা বেশি নেই। তবে এখনও বাঙালি ১৪ প্রদীপ বলতে মাটির প্রদীপই বোঝে। তা ছাড়া আরতির সময় নিবেদন করা প্রদীপও মূলত মাটিরই। তাই এখন কাজের অভাব নেই পালপাড়ায়। ব্যস্ত পালপাড়া।
কিন্তু যে পরিমাণ পরিশ্রম তাঁরা করেন, আর যে পরিমাণ খরচ তাঁদের হয়, তাতে তাঁদের লভ্যাংশ দিন-দিন কমছে। অথচ, তাঁদের খাটুনি কম নয়। মাটি তৈরি থেকে শুরু করে মাটির পাত্র বানানো তাকে রোদের শুকিয়ে রং করে পোড়ানো পর্যন্ত যে খাটনি হয়, সেই অনুপাতে উপার্জন নেই তাঁদের।
সাধারণ হিসেব অনুযায়ী, মাটি তৈরি করার জন্য প্রতিদিন গড়ে চার জন শ্রমিক দরকার। ১৫ দিন সময় লাগে একটা ভাটা তৈরি করতে যেখানে সব ধরনের সামগ্রী পোড়ানো হয়। চারজন করে শ্রমিক ১৫ দিন কাজ করলে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে হয় কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা। যে পরিমাণ কাঠ একটি ভাটা পোড়াতে লাগে, তার দাম ২০০০ টাকা। অথচ জিনিসপত্রের দাম এখনও কিছু ক্ষেত্রে একই রয়ে গিয়েছে, বা কিছু ক্ষেত্রে দাম কমে গিয়েছে। তাই লাভ হয় না।
মহাদেব পাল বলেন– প্রদীপ-সহ পুজোর সামগ্রী মাটি দিয়েই বানানো হয়। এর চাহিদা সারা বছর। আমরা সংস্কারের কারণে বৈশাখ মাসে কাজ বন্ধ রাখি। বাকি ১১ মাসে কাজ থাকে। পুজার মরসুমে চাপ একটু বেশি। যতই বিদ্যুতের আলো লাগানো হোক এখনও মাটির প্রদীপর চাহিদা আছে। সারা বছর কাজ থাকে, মাটর জিনিসের চাহিদাও আছে, কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।
আরও পড়ুন: Malbazar: পঁচাশি বছর আগে দুর্ভিক্ষের সময়ে শুরু! বিরল কী মেলে ধনকুবেরের এই পুজোয়?
পাল পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দাই বাংলাদেশ থেকে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন ৭০ দশক থেকে ৯০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে। ছিন্নমূল মানুষগুলি নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে এপার বাংলায় এসে নিজেদের জীবন-জীবিকা বাঁচাবার লড়াইয়ে সামিল হন। তা করতে গিয়ে বাপ-ঠাকুরদাদার পেশাকেই অবলম্বন করে চলতে শুরু করেছেন তাঁরা। আজও তাই পালপাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ভাটা ও চাকা রয়েছে। মাটির কাজ কমবেশি সকলেই করছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এই শিল্প থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। কোনও পরিবারেই আর নতুন প্রজন্ম এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না আক্ষেপ করে বলেন সহদেব পাল।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)