চোখধাঁধানো সরকারি প্রাইমারি স্কুল জঙ্গলমহলে! স্কুল তো নয়, যেন একখণ্ড পৃথিবী। ক্যাম্পাসেই রাখা হাতি-ঘোড়া, ঝিনুক-কচ্ছপ, রংবাহারি গুবরে পোকা। রয়েছে মজারু এক রেলগাড়িও। আসল নয়, মডেল! বাগানের মধ্যেই ভিড় করেছে বাংলা-ইংরেজি অক্ষর, সংখ্যা চেনাচ্ছে মাইল ফলক। আর দেওয়াল জুড়ে ছবি। এই পড়া পড়া খেলাতেই হুটোপুটি আনন্দ খুদেদের। চলতে-ফিরতে যখন পড়া হয়ে যায়, ঘটা করে কে আর বই নিয়ে বসে!
না, শহরের নামী কোনও বেসরকারি স্কুল নয়, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সেজে উঠেছে এমন ভাবে। মেদিনীপুর শহর থেকে নয়-দশ কিলোমিটার দূরে নয়াগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের ভাররাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিপ্লব আর্য নিজের চেষ্টায়, গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে, স্কুলকে সাজিয়ে তুলেছেন। নিজের পকেট থেকে বেতনের টাকা তো খরচ করেইছেন, গ্রামের মানুষকে বুঝিয়ে সাহায্য নিয়েছেন তাঁদেরও।
কখনও বা কোনও সংস্থার কাছে হাত পেতেছেন। রাজ্যের আর পাঁচটা প্রাইমারি স্কুলের থেকে তাই একেবারেই আলাদা নয়াগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রত্যন্ত গ্রামের মাঝে এমন একটা স্কুল, যা দেখলে মন ভরে যাবে যে কোনও মানুষের। এলাকার বাসিন্দা আরতি পণ্ডা, ভীম দে, বিজয় চালক, হিমাংশু সেনরা বলেন, ‘আমরাও এই স্কুলে পড়েছি, অনেক শিক্ষক দেখেছি। কিন্তু বিপ্লব মাস্টারের মতো শিক্ষক এই স্কুলে আসেনি। ছেলেরা স্কুলে না এলে, বাড়িতে চলে যান খোঁজ নিতে। কোলে করে বাচ্চাদের নিয়ে আসেন। এই স্কুলটা আমাদের গ্রামের একটা আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিপ্লব আর্য বলেন, ‘এখানে এসে দেখলাম, গ্রামের মানুষজন খুব ভালো। স্কুলটাকে সুন্দর করে সাজানোর ইচ্ছে হলো। বহুবার এগিয়েও আবার পিছিয়ে গিয়েছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ ছিল। এই সুযোগটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। বর্ধমানের শিল্পী রাধেশ্যাম বসাক এবং স্থানীয় শিল্পী দীপঙ্কর মাঝিকে দিয়ে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ।’
কিন্তু স্কুল সাজাতে তো অনেক খরচ?
বিপ্লববাবুর উত্তর, ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় ঠিক বেরিয়ে যায়। প্রথমে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে কাজ শুরু করেছিলাম। স্কুলের সাত জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁদেরও সাহায্য পেয়েছি। তারপর গ্রামবাসী এবং বিভিন্ন সংস্থার কাছে হাত পেতেছি, বিদ্যালয়কে সাজিয়ে তোলার জন্য। সবাই সাহায্য করেছেন।’
করোনা পরিস্থিতিতেও প্রায় প্রতিদিন বিদ্যালয়ে গিয়েছেন তিনি। স্কুলকে সাজিয়ে তোলার কাজকর্ম দেখভাল করার জন্য। সকাল থেকে সন্ধে স্কুলেই কাটিয়েছেন। কোথায় কী করলে আরও সুন্দর করে সাজানো যাবে, সে চিন্তা তাঁর মাথায় ঘোরে প্রতিনিয়ত।
গ্রামের বাসিন্দা, শালবনির ভাতমোড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমেনকুমার দে বলেন, ‘বিপ্লব স্যারের তুলনা হয় না। স্কুলের জন্য তিনি কী না করছেন! পুরোপুরি নিজের উদ্যোগে এত কাজ করে চলেছেন।’ ২০৮ জন ছাত্রছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিপ্লব’ করে চলেছেন জঙ্গলমহলের বিপ্লব মাস্টার!