Animal Movie | Ranbir Kapoor: রণবীর অসাধারণ, তবে অ্যানিম্যালের সাফল্য অশনি সংকেত…


অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: রাত ১১টা। সল্টলেকের অফিসপাড়ায় এক মাল্টিপ্লেক্সের সামনে উপচে পড়ছে ভিড়। চারিদিকে দেখা যাচ্ছে সারি সারি কালো মাথার ঢল। চলন্ত সিঁড়ি দাঁড় করিয়ে দিতে হয়েছে যাতে মানুষ দাঁড়াতে পারে। না না, কিং খান বা ভাইজান নয়।এই ভিড় অ্যানিম্যালের।

হ্যাঁ সন্দীপ রেডি ভাঙ্গার অ্যানিম্যাল। হ্যাঁ রণবীর কাপুরের অ্যানিম্যাল, এবং অবশ্যই ববি দেওলের অ্যানিম্যাল। কলকাতা শহরে রণবীর কাপুরের এতো ক্রেজ ছিল নাকি! সুদূর অতীতে তাঁর কোনও সিনেমা নিয়ে এতো মাতামাতি হয়েছে বলে মনে পরে না। এই শহর যেমন প্রাচীন তেমনই একটু প্রাচীনপন্থী এই শহরের সিনেমা ভালো লাগা। ছোটবেলা থেকে সিঙ্গেল স্ক্রিনের সামনে শাহরুখ থেকে সলমানের পাহাড়প্রমাণ কাটআউটে মালা পরিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া দর্শক হঠাৎ চকলেট হিরোর প্রেমে কবে পড়ল?

কেন ক্রেজ অ্যানিম্যালের?

প্রথম দিনেই সিনেমা হলে ঢোকার আগেই কিছুটা আন্দাজ করা গেল এই সিনেমার ক্রেজ হঠাৎ এতো কেন। হলের বাইরে ভিড়ের বয়স দেখলেই বোঝা যাচ্ছে রক্তের তেজ। ভিড়ের বয়স দেখলে বোঝা যাচ্ছে প্রতিশোধের স্পৃহা। ভিড়ের বয়স বলে দিচ্ছে বদলাচ্ছে বাঙালি। 

এই ভিড় বলে দিচ্ছে সিনেমার ক্রেজ হিরোর নামে নয়। এই সিনেমার ক্রেজ অ্যাকশনে। এই সিনেমার ক্রেজ প্রতিশোধে, তার পদ্ধতিতে। সেই প্রতিশোধ জায়েজ হোক বা না হোক। 

হলের বাইরের ভিড় আপনাকে শুরুতেই বলে দেবে এই সেই বাঙালি যে রোজ কর্পোরেটের গোলামি করতে করতে জীবনের কাছে হেরে যাচ্ছে। এই সেই দর্শক যে রোজ বসের খিস্তি শুনেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে মাসের শেষের ইএমআই-টা যাতে ঠিকভাবে মেটাতে পারে। আর এই চেপে রাখা রাগ যা সমাজ, ইএমআই, আইন-কানুন, সংসারের চাপে শুধু মাত্র দু’পাত্তরের মধ্যে দিয়ে বেরোয়; সেই রাগের বহিঃপ্রকাশকে সিনেমার টিকিটে সফলভাবে বদলে দিতে পেরেছেন সন্দীপ। 

অ্যানিম্যাল বনাম জয় শ্রী রাম 

এই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া ক্রাউডই যখন আপনার সামনে রাত ১১.১৫ টায় হঠাৎ গগনবিদারী ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি দিয়ে উঠবে, আপনি চমকে উঠে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য যে আপনি কোন সিনেমা দেখতে এসেছেন। অ্যানিমালের সঙ্গে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আপনি বিজেপি-র লিঙ্ক খোঁজার চেষ্টা করবেনই। যদিও সিনেমার তিন ঘণ্টায় আপনি ১-২টো ডায়লগ ছাড়া রাজনীতির কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাবেন না। 

তাই শুরুতেই নব্বই দশক অথবা তার আগের বাঙালি দর্শক এক সাংস্কৃতিক ধাক্কা খেতে বাধ্য। পপকর্ন হাতে দাঁড়িয়ে আপনি যখন ভাবছেন যে এটা কোনও পলিটিকাল সিনেমা কিনা ঠিক তখনই এই একই ক্রাউডের মুখে ঠিক অন্য গল্প শুতে গিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন যে এই জয় শ্রী রাম ধ্বনির সঙ্গে সিনেমার অথবা রাজনীতির যোগ ঠিক ততটাই কম যতটা সিনেমাপ্রেমী দর্শক এবং শুধুই ‘বিনোদনের’ জন্য সিনেমা দেখতে আসা দর্শকের মধ্যে যোগ। 

আরও পড়ুন: Arijit Singh: ‘আমি এগুলো পছন্দ করি না…’, কনসার্টে গান থামিয়ে দিলেন অরিজিৎ!

সিনেমার দৈর্ঘ্য 

এই সিনেমার সবথেকে বড় মাইনাস পয়েন্ট এর সময়। ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিট ধরে দর্শককে শুধুমাত্র অ্যাকশন দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা কতটা সফল তা অ্যানিম্যালের বক্স অফিস কালেকশন বলবে। কিন্তু ওটিটি-র জমানায় টিকিট কেটে ৩ ঘণ্টার সিনেমা দেখতে এসে দর্শক যদি কোনও গল্প না পায় তাহলে সিনেমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।      

সিনেমার গল্প

এবার আসা যাক সিনেমার গল্পে। শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে এক বালককে। যে তার বাবার প্রেমে পাগল কিন্তু বাবা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাবা ব্যাস্ত ব্যাবসায়। দেশের সফলতম ব্যাবসায়ির ছেলে সে। বাবার জন্মদিনে সকলের  মধ্যে চকলেট বিলি করছে। জীবনের লক্ষ্য একটাই, একদিন বাবার সামনে প্রমাণ করে দেওয়া যে বাবার প্রতি তার ভালোবাসা ‘পাশ’। 

এর বেশি গল্পে আমাদের না গেলে হবে কারণ সিনেমার গল্পে এর থেকে বেশি কিছু নেই। যা আছে তা হল এই প্রমাণ করার তাগিদ এবং সেই তাগিদ থেকে ধীরে ধীরে গ্যাংস্টার হয়ে ওঠা। 

এই স্কুলের ছেলে পৌঁছে যাচ্ছে দিদির কলেজে। নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে ক্লাসের মধ্যে, গাড়ি নিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে দিদির ইভটিজারদের। সেই দেখে প্রেমিকা ভাবছে দিদির জন্য এই হলে আমার জন্য কী করবে। ঠিক এখানেই ফিরে আসছে বাবা। লৌহমানব বাবা তার বেয়াদব ছেলেকে পাঠাচ্ছে বোর্ডিং স্কুলে। সেখানেই নাকি ঠিক হবে তার ছেলে। 

বেয়াদব ছেলে অন্যের বিয়ে ভেঙে নিয়ে পালাচ্ছে বিয়ের কনেকে। আকাশে উড়ছে চার্টার্ড বিমান। প্লেনে কোনওদিন না ওঠা প্রেমিকা চালাচ্ছে বিমান। যেকোনও সময়ে প্রেমিকার গলা টিপে ধরা যাচ্ছে কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে যে আসলে এই গলা টিপে ধরার মধ্যেও কোথাও একটা প্রেম লুকিয়ে রয়েছে। এখানে নিজের বিয়ে ভেঙে যায় যাক বাবার উপরে হামলার প্রতিশোধ নিতেই হবে। বাবার শত্রুকে খুঁজে বের করতে অনায়াসে অন্য মহিলার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো যাচ্ছে। আবার করবা চৌথে অভুক্ত বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সেটা অকপটে স্বীকার করে নিয়ে মনে করা হচ্ছে বউ তাও ক্ষমা করে দেবে। আলফা মেল বল কথা। তাঁর সব সিদ্ধান্তই সঠিক। ঘর ভেঙে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও ফিরে আসতে হয় বউকে কারণ সুক্ষভাবে সন্দীপ দেখিয়ে দিচ্ছে গাড়ির দরজা খুলে বাবার দিকে দৌড়ে পালিয়ে আসছে ছেলে। অর্থাৎ আবার আলফা মেল।      

আরও পড়ুন: Shah Rukh Khan: আমেরিকা নয়, খোদ মুম্বই বিমানবন্দরে জেরার মুখে শাহরুখ!

যাই হোক সিনেমার প্লটের থেকেই বেশি করে উঠে আসছে কয়েকটি প্রশ্ন। যেকোনও প্রেম বা ভালবাসা, সে বাবা-ছেলে অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা হোক, সেই প্রেম বা ভালবাসাকে অবসেশনের জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং সেই অবসেশন থেকে পাগলামোর জায়গায় পৌঁছে যাওয়াকে কে এতোটাই স্বাভাবিক হিসেবে দেখাচ্ছেন পরিচালক যে জনমানসের তার সুদূর প্রসারী প্রভাব পরতে বাধ্য। যদি আগামীদিনে ভারতেও কোনও স্কুলে নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে আর আমাদের পরের প্রজন্ম যদি রেগে ওঠার পরিবর্তে প্রতিশোধস্পৃহাকে সেলিব্রেট করে তাহলে আমাদের কিছুই হয়ত বলার থাকবেনা।

অভিনয় কেমন?

এই সিনেমায় রণবীর কাপুরের অভিনয় তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতন। এক চরিত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শেডকে অসাধারণ দক্ষতায় আলাদা আলাদা করে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তাতে স্ট্যান্ডিং ওভেশন তার প্রাপ্য। ভালবাসা, ট্রাবল্ড শৈশব, প্রেম, রাগ, প্রতিশোধ প্রতিটি ফেজে রণবীর অতুলনীয়। 

নেগেটিভ রোলে ববি প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। যে সামান্য সময় এই সিনেমায় তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে ববি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে বলিউড তাঁকে সঠিকভাবে কোনও দিনই ব্যবহার করতে পারেনি। সামান্য স্ক্রিন প্রেজেন্স তার উপরে নেই কোনও সংলাপ। এরপরেও দর্শকের মনে আলাদা করে দাগ কেটে যাবে ববির অভিনয়। 

সব শেসে আসা যাক নায়িকা রশ্মিকা মান্দানার প্রসঙ্গে। এই সিনেমায় প্রচুর স্পেস পেয়েও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ দক্ষিনী সুপারস্টার। তাঁর ডায়লগ বেশিরভাগই বেরিয়ে গেল দর্শকের মাথার উপর দিয়েই। চরিত্রের বিভিন্ন দিক গুলি তুলে ধরতে ব্যর্থ রশ্মিকা। হয়ত রনবীর কাপুরের চরিত্রের চাপে কিছুটা হলেও তিনি ফিকে হয়ে গিয়েছেন কিন্তু তারপরেও সুযোগ ছিল গীতাঞ্জলীর চরিত্রের শেডগুলিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরার। 

অবশেষে

সন্দীপের বিভিন্ন সিনেমায় আমরা এর আগেও দেখেছি পুরুষ প্রোটাগনিস্টকে ‘আলফা মেল’ হিসেবে দেখানো এবং মহিলা নায়িকাকে পরজীবীর মতন দেখানোর প্রবণতা। সেই প্রবণতার বদল এই সিনেমাতেও হয়নি। পাশপাশি এই সিনেমার দৃশ্যায়ন এবং সংলাপে সরাসরি ‘আলফা মেল’ কনসেপ্টকে প্রোমোট করা এবং আমাদের উদ্বাহু হয়ে সেই ভাবনাকে সমাদরে গ্রহণ করা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী নজির তৈরি করবে তা অত্যন্ত ভাবনার বিষয়। যে সমাজে প্রতিদিন লড়তে হয় নারীর সমানাধিকারের জন্য, সেই সমাজে নারীর উপর ভায়লেন্স, তাকে নির্ভরশীল চরিত্র বানানো, তার মতামতের গুরুত্ব না থাকা এবং টক্সিক মাস্কুলিনিটিকে ভালবাসার মোড়কে সাধারণ মানুষকে খাইয়ে দেওয়া কোনওভাবেই সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে বলে মনে হয় না।

(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)

 





Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *