জ্বলন্ত উনুন থেকে একরত্তি মেয়েটাকে তুলে কলাপাতায় মুড়ে হাসপাতালে দৌড়েছিলেন বাবা-মা। সারা শরীরের পোড়া দাগ দেখে অনেকেই যেচে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘এ মেয়েকে আর বাড়ি ফেরানোর দরকার নেই। সারা শরীর তো জ্বলেপুড়ে গিয়েছে। কী হবে এ মেয়ের?’ জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েটার হাতে আজ ফুটবল মাঠের রাশ! তাঁর হুইশলের আওয়াজে কখনও মাঠ জুড়ে বল ঘোরে এ পায়ে-ও পায়ে, উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে গ্যালারি, আবার কখনও থমকে যান ফুটবলাররা।
মাধ্যমিকের পরেই বিয়ে দিতে বলেছিলেন আত্মীয়েরা। মুখের উপর জবাব দেয় মেয়ে, ‘আমি পড়তে চাই।’ সে মেয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করেন কন্যাশ্রী কাপের ময়দান। যে মেয়েটার হাফ প্যান্ট পরা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল মহল্লা জুড়ে, সে মেয়ে এখন আইএফএ-র রেফারি। কলকাতার বিভিন্ন মাঠে দাপটের সঙ্গে সামলান মহিলা ফুটবল লিগ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনির প্রত্যন্ত তিলাখুলা গ্রামের তার্জুনা মণ্ডল। বাবা তৈমুর আলি মণ্ডল ক্ষুদ্র কৃষক, মা সোকিনা বিবি গৃহবধূ। দুই ভাই ভিনরাজ্যে স্বর্ণশিল্পীর কাজ করেন। তার্জুনা নিজেও সিভিক ভলান্টিয়ার।
ছোটবেলায় ধানসিদ্ধ করার উনুনে পড়ে গিয়েছিলেন। পুড়ে যায় শরীরের অনেকটা অংশ। বেঁচে ফিরবেন, ভাবতে পারেননি স্বজনরা। ফিরে আসেন সারা শরীরে পোড়ার দাগ নিয়ে। সে দুর্ঘটনার ফলে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন বলে পাড়ায় নাম হয়ে যায় ‘খুঁড়ি’। বাঁ হাতের আঙুলগুলি তো জুড়ে রয়েছে আজও।
তার্জুনার ফুটবলের নেশা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। টিফিন টাইমে স্কুলমাঠে ছেলেদের খেলা দেখতেন মন দিয়ে। মনে মনে চাইতেন খেলতে। একদিন সংকোচ সরিয়ে স্কুলে স্পোর্টস টিচারকে সে কথা বলেই ফেলেন। শিক্ষক তাঁকে ফুটবল খেলতে নামিয়ে দেন ছেলেদের সঙ্গে। সে বার পায়ের দুর্দান্ত কারিকুরিতে হিমশিম খাইয়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের। শিক্ষক বোঝেন, এ মেয়ের পায়ে ম্যাজিক আছে।
ততক্ষণে আব্দার করে ফেলেছে ছাত্রী, ‘স্যর আমাকে ফুটবল খেলা শেখাবেন? ছেলেরা খেলছে, মেয়েদের একদল দল তৈরি করলে হয় না?’ এর পরেই স্কুলে তৈরি হয় ছাত্রীদের ফুটবল টিম। খেলা শুরু করেন তার্জুনা। তবে রাস্তা মোটেও সহজ ছিল না। হাফ প্যান্ট পরাই যে অপরাধ তাঁর এলাকায়। তার উপরে এক মাঠ লোকের সামনে ফুটবল খেলা! দিনের পর দিন বাড়িতে বুঝিয়েছেন স্পোর্টস টিচার। বাবা-মা নিমরাজি হতেই মাঠে নেমে পড়েন তার্জুনা। ভালো প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন শালবনির জাগরণ ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
স্কুল ফুটবলে একাধিক বার রাজ্যস্তরে খেলেছেন। স্কুল ফুটবল লিগে খেলেছেন জাতীয় স্তরেও। স্কুল শেষে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়েছেন তার্জুনা। পড়তে পড়তেই পেয়ে যান সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি। সঙ্গে চলতে থাকে ফুটবল খেলা। এর পরে একসময় ফুটবলের রেফারি হওয়ার নেশা চেপে বসে। সে ট্রেনিং নিয়ে এখন তিনি আইএফএ-র রেফারি।
জাগরণ ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সম্পাদক, মেদিনীপুর সদর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক সন্দীপ সিংহ বলেন, ‘অভাব আর সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই প্রথমবার মাঠে আসে তার্জুনা। পরিবারের আপত্তি ছিল। ওর বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে মাঠে নিয়ে আসতে হতো তার্জুনাকে। ধীরে ধীরে একজন নির্ভরযোগ্য ফুটবলার হয়ে ওঠে মেয়েটা। আজ যেভাবে জেলার গণ্ডি অতিক্রম করে সারা রাজ্য ও দেশের ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে জঙ্গলমহলের মানুষ হিসেবে গর্ব বোধ করি।’
কলকাতা রেফারি সংস্থার সচিব উদয়ন হালদার বলেন, ‘তার্জুনার এই তো শুরু। ধৈর্য ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে এগিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য থেকে সরে গেলে চলবে না।’
তার্জুনা বলেন, ‘ফুটবল খেলতে গিয়ে যে কত খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। কারও কথায় কান না দিয়ে খেলায় ‘ধ্যান’ দিয়েছি। পরিবারের বাধা, সমাজের বাধা। এখন তো মনে হয় ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। সামনে এখনও অনেক পথ বাকি।’
হাজার বাধার পাহাড় টপকেও ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তার্জুনা। আগুনে পুড়েও হেরে যাননি। শরীরে পোড়া দাগ নিয়ে এ যেন এক ফিনিক্স পাখির গল্প!