মন্দার বোস নয়, আসল গ্লোবট্রটার! ১৯ বছরে ১৯১ দেশ ঘুরে প্রত্যাবর্তন – for the last 19 years somen debnath from sundarbans has cycled to 191 countries of the world


সোমনাথ মণ্ডল
ধর্মতলার ফুটপাথ থেকে কেনা মরা সাহেবের কোট নেই গায়ে। পায়ে বাটার কালো জুতোও নয়। ট্যাঙ্গানিকায় নেকড়ের চাষ হয়, এমন দাবিও করছেন না একবারও। আসলে ইনি তো সত্যজিতের গল্পের ‘ভবানন্দের চ্যালা’ মন্দার বোস নন! বাস্তবের গ্লোবট্রটার। ক্যান্সার আর এডস নিয়ে সচেতনতা ছড়াতে গত ১৯ বছর ধরে বিশ্বের ১৯১টি দেশ সাইকেলে চষে বেরিয়েছেন সুন্দরবনের বাসন্তীর ছেলে সোমেন দেবনাথ!

আফগানিস্তানে তালিবানের হাতে বন্দি হয়ে রাঁধুনির কাজ করেছেন, বেজিংয়ে আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, অতিমারির জেরে সীমান্ত বন্ধ থাকায় নিউ জ়িল্যান্ডে নদীর ধারে, জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, উত্তর মেরুতে দেখা পেয়েছেন এস্কিমোর। সঙ্গী সেই সাইকেল আর তাতে ঝোলানো সচেতনতার বোর্ড। ২০০৪ সালে শেষবার সামনাসামনি দেখেছিলেন পরিবারকে। তার পর অনেককে হারিয়েছেন। বাবা, দাদু-দিদিমার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন সফরকালে। ১৯ বছর পেরিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় আবার যখন বাড়ির চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ালেন, মা’কে দেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন, তখন কারও মুখেই ভাষা নেই। মা-ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেক ক্ষণ।

সাহিত্যপ্রিয় বাঙালিকে তাদের স্বপ্নের গ্লোবট্রটার খুঁজে দিয়েছিলেন সেই সত্যজিৎ রায়ই। মানসভ্রমণেই যেন বিশ্বদর্শন করিয়েছিলেন ৩৫ বছর পর দেশে ফেরা ‘আগন্তুক’ উৎপল দত্ত। বাসন্তীর সোমেনের অভিজ্ঞতাও বাড়ি থেকে পালানো সেই ‘ছোটমামা’র থেকে কম নয়। তবে কি, সোমেন ‘বাউন্ডুলে ঘুড়ি’ নন। নিরুদ্দেশ হননি। বরং খুব ভেবেচিন্তে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন একটা ভয়ঙ্কর ‘টাস্ক’ নিয়ে।

সোমেন যখন সবেই ১৪, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগীর মৃত্যু তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিশোর মনে প্রশ্ন উঠেছিল, ক্যান্সার হলেই কেন অসহায় হয়ে মরতে হয় মানুষকে? কোনও চিকিৎসা নেই? একই প্রশ্ন ভিড় করে এডস নিয়েও। সোমেনের মনে হয়, সবাইকে সচেতন করতে হবে মারণ রোগ নিয়ে।

প্রাণিবিদ্যা নিয়ে স্নাতক। কলেজে পড়া শেষ করে মাত্র ২০ বছর বয়সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সোমেন। তার আগে রিজিওনাল এডস কন্ট্রোল সোসাইটি থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণও নেন। সালটা ২০০৪। প্রথম দু’বছর দেশের মধ্যে, তার পর ২০০৬-০৯ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ২০১১ পর্যন্ত ইউরোপ, তার পর আফ্রিকা, ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া – সোমেনের সাইকেলের চাকা থামেনি। এখন সেই ‘তরুণ’ চল্লিশ ছুঁয়েছেন। ৩৮টি দেশের প্রেসিডেন্ট, ৭২টি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। যাত্রাপথ প্রায় দু’লক্ষ কিলোমিটার! সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষের কাছে।

অথচ এই সোমেনই যখন ২০২০ সালে চিন সফর করতে গিয়ে বেজিং পৌঁছন, ভাবতেও পারেননি, মারণ কোভিড ১৯ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য! যে অজানা রোগে হঠাৎ চারদিকে যেন মড়ক লেগেছে, সেই রোগই লকডাউনে থমকে দেবে বিশ্বকে। সোমেনের কথায়, ‘রাশিয়া হয়ে যখন বেজিং পৌঁছলাম, তখন হঠাৎ হোটেল বন্দি হয়ে পড়ি। হোটেল কর্মীরা বাইরে বেরোতে দিচ্ছিলেন না। তাঁরাই জানালেন কোভিড-১৯ বা করোনা নামের রোগে সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। আমিও হলাম। আমার হঠাৎ কি যেন মনে হলো, কিছু না বুঝতে পারে, গরম জল গালে ঢেলে দিলাম। মুখের ভিতর পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘর থেকে বেরোইনি। কোনওভাবে বেঁচেও যাই।’

তাতেও হাল ছাড়েননি সোমেন। বললেন, ‘নিউজিল্যান্ডে পৌঁছনোর পর, সেখানকার সরকার এক বছরের জন্য বিদেশ থেকে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ওই সময়ে কখন নদীর ধারে টেন্ট করে, কখনও জঙ্গলে কাটিয়েছি। আবার কখনও হোটেলেও ছিলাম।’ ইউএসএ থেকে করোনার টিকা নিয়ে ফের এডস সচেতনতা প্রচারে সাইকেল সফর শুরু করেন। বাংলাদেশ ঘুরে রবিবারই বাসন্তীর বাড়িতে পৌঁছন সোমেন।

এবার কী করতে চান ‘গ্লোবট্রটার’?

‘২০ বছর ঘুরেছি, অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা। স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এডস নিয়ে সচেতনতা প্রচারও চালিয়েছি। সে সব নিয়ে বই লিখব। আর বাড়িতে একটা ছোট সংগ্রহশালা বানাব’ – হেসে বললেন সোমেন।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *