সত্যিই তো, বহুদিন ধরে ওঁরা প্রত্যেকেই সমাজের রক্তচক্ষু, উপেক্ষা-উপহাস ও নির্যাতনের বেড়াজালে আবদ্ধ। তবু রবিবার শহরের বুকে তৃতীয় লিঙ্গ, রূপান্তরকামী, সমপ্রেমী মানুষের প্রাইড ওয়াক থেকে সোচ্চার ঘোষণা-পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আরও বদল দরকার।
শুধু কলকাতার রূপান্তরকামী বা সমপ্রেমীরা নন, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সামনে থেকে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রায় গানের সুরে সুর মেলালেন অনেকেই। পার্ক স্ট্রিটের বেশকিছু রেস্তরাঁর দু’পাশও সাজানো হয়েছিল রামধনুর সাত রংয়ে। এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির বাইরেও প্রচুর সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, গায়ক, ফটোগ্রাফাররা যোগ দেন এই প্রাইড ওয়াকে।
মিছিলে উপস্থিত নাগরিকরা স্লোগান তুলেছেন, ‘আমার শরীর, আমার মন, দূর হঠো রাজশাসন!’ অথবা ‘ছেলেতে ছেলেতে প্রেম করেছে, বেশ করেছে, বেশ করেছে।’ নারী-পুরুষের তথাকথিত বাইনারি ভেঙে রাজপথে সেই ১৯৯৯ থেকে আয়োজিত হচ্ছে কলকাতা প্রাইড ওয়াক। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে পথ হাঁটার পর কতটা পরিবর্তন হলো পরিস্থিতির?
রূপান্তরকামী নারী বন্যা আশাবাদী। আবার মেনেও নিচ্ছেন, এখনও অনেক লড়াই বাকি। বন্যার কথায়, ‘সেই ১৯৯৯-এ যখন পথচলা শুরু হয়েছিল, তখন পুলিশ আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিত। আর আজ দেখুন, সেই পুলিশই আমাদের গার্ড করে মিছিলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘এটা কি পরিবর্তন নয়?’ গানে-স্লোগানে, রাজপথে হাতে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অথবা ঠোঁটের কোনে হাল্কা চুমুর ছোঁয়ায় যেন সায় দেন মিছিলের বাকিরাও।
২৪ বছর আগে চার-পাঁচজনের হাত ধরে শুরুটা হয়েছিল এই পথ চলার। প্রাইড ওয়াক নামটা তখনও ছিল না। তখন ছিল-ফ্রেন্ডশিপ ওয়াক। আজ মিছিল যেন জনসমুদ্র। সেখান থেকে দাবি উঠেছে নির্যাতন ও বৈষম্য বিরোধী সমাজেরও। যে কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন শাড়ি-ব্লাউজে মিছিলে সামিল হালিশহর থেকে আসা সায়ন-এই প্রাইড ওয়াক আমাদের হকের আজ়াদির জন্য। আমাদের দেশ অনেকদিন স্বাধীন হয়েছে।
কিন্তু আমরা আজও স্বাধীন হতে পারিনি। শুধুমাত্র স্কুলে, কলেজে, কর্মক্ষেত্রে বা সমাজেই নয়, পরিবারের মধ্যেও আমাদের বলি হতে হচ্ছে। আমরা সেই পরিস্থিতির বদল চাই। ইদানীং সরকারি নানা প্রকল্প এবং বেসরকারি ক্ষেত্রেও জন সচেতনতার কারণে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হলেও মিছিলে উপস্থিত রূপান্তরকামী পুরুষ সোহমের কথায়, ‘কিন্তু আজও আমরা কাজ চাইতে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন ভাব করা হয়, যেন আমরা মানুষই নই। এ বছরের মিছিলে সমানাধিকার, মানবাধিকারের পাশাপাশি আমরা কর্মসংস্থানের দাবিও তুলছি।’
দাবি উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার নিউট্রাল টয়লেটেরও। বেহালার বাসিন্দা সমকামী পুরুষ কুশল চক্রবর্তী বলেন, ‘বিয়ে করার অধিকার আমাদের এখনও নেই। একটা ছেলে আর একটা ছেলেকে ভালোবেসে তাঁর সঙ্গে ঘর বাঁধতে চাইলে বাধা কোথায়?’ রূপান্তরকামী মহিলা বীথি দত্তের কথায়, ‘এমনটা বলব না, কোনও পরিবর্তনই হয়নি। তবে বাস, মেট্রো বা ট্রেনে আমাদের জন্য সিট রিজার্ভ বা কোনও ছাড় ঘোষণা হয়নি।’
অবশ্য যা হয়নি, সারা পৃথিবীর আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রামধনু একদিন সেই সব কিছু আদায় করতে পারবে-সেই বার্তাই যেন দিয়ে গেল কলকাতার প্রাইড ওয়াক!