‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ যাঁদের পড়া আছে অথবা ওয়েব সিরিজে দেখা, তাঁদের কাছে এই রেফারেন্স নতুন নয়। লেখক কল্লোল লাহিড়ী এ ভাবেই তাঁর উপন্যাসে তুলে এনেছিলেন অভাবের সংসারের এক রন্ধনশিল্পীর কথা, যিনি যৎসামান্য উপকরণেও স্রেফ হাতযশে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর খাদ্য সাম্রাজ্য।
মিড ডে মিলের রান্নার সহায়িকারাও যেন এমনই। সামান্য বরাদ্দে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। তাই দিয়েই ছোট ছোট ক্ষুধার্ত মুখগুলোয় তুলে দিতে হয় খাবার। অথচ সকলেই তো চান যে, মাছ, মাংস, লাড্ডু, পায়েস না হোক, অন্তত ডাল-ভাত-সব্জিটুকু স্বাদ আর পরিবেশন, পরিচ্ছন্নতায় এমন হয়ে উঠুক যেন পুষ্টি আর স্বাদ দুটোই বজায় থাকে।
সেই সদিচ্ছা সামনে রেখেই রাজ্যজুড়ে মিড ডে মিলের রন্ধন কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়েছে। ট্রেনিং শেষে ব্যবস্থা করা হবে কুকিং কম্পিটিশনেরও, যাতে সেরা হাতের সুস্বাদু রেসিপির স্বাদ অন্যান্য স্কুলের রন্ধনকর্মীরাও ভালো করে শিখে নিতে পারেন। ছেলেমেয়েদের পেট ভরবে, মুখে ফুটবে তৃপ্তির হাসি।
নতুন বছরের জানুয়ারির ১৬ তারিখ দিল্লিতে মিড ডে মিল, অধুনা ‘পিএম পোষণ যোজনা’র প্রজেক্ট অ্যাপ্রুভাল বোর্ডের মিটিংয়ে যাবে রাজ্য। তার আগে কেন্দ্রের কয়েকটি সুপারিশ ছিল। যেগুলির মধ্যে ছিল মিড ডে মিলের কুকদের নিয়ে এমন রন্ধন প্রতিযোগিতা, ট্রেনিংয়ের কথা। সেই সুপারিশ মেনে ইতিমধ্যে কলকাতা জেলার মিড ডে মিল কর্তৃপক্ষ ট্রেনিং প্রোগ্রাম করেছেন।
তারাতলার কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ হোটেল ম্যানেজমেন্ট কেটারিং টেকনোলজি অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশন-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের পুষ্টিবিদ, শ্যেফ, হাইজিন এক্সপার্টদের দিয়ে মিড ডে মিলের রাঁধুনিদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না করতে হবে, কোন ধরনের রান্নায় কতটা উপকরণ ব্যবহার করলে সেটা শিশুদের উপকারে আসবে, কোন টোটকায় খাবারের স্বাদ বাড়বে— এক্সপার্টরা মূলত সেই সব বিষয়ে ট্রেনিং দিয়েছেন।
কলকাতা জেলার মিড ডে মিল কর্তৃপক্ষের এক আধিকারিকের কথায়, ‘আমরা কুকিং কম্পিটিশনের মাধ্যমে সেরা রেসিপিগুলো তুলে আনব। যাঁরা প্রতিযোগিতায় জয়ী হবেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে। তাঁদের রেসিপি বাকিদের সঙ্গেও শেয়ার করে নেওয়া হবে।’
মিড ডে মিলের খাবার নিয়ে অনেক সময়েই নানা অভিযোগ ওঠে। সাদা ভাত, ট্যালটেলে ডাল আর শাকপাতা দিয়ে কোনওক্রমে তৈরি করা একটা তরকারি অথবা অন্য অনেক রান্না মুখরোচক হয় না বলে মুখেও তোলে না অনেক বাচ্চা। খাবার অনেক সময়ে নষ্টও হয়। সর্বত্র একই চিত্র নয় যদিও। কিন্তু সেই অভিযোগগুলিকে আরও কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা রয়েছে রাজ্যের।
এর আগে কেন্দ্রের পাঠানো মিড ডে মিলের তদন্তকারী দলের সদস্যদের রিপোর্টেও রাজ্যের খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি, হাইজিন বাড়ানোর সুপারিশ ছিল। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের লেখক কল্লোল লাহিড়ী মনে করেন, খাবারের স্বাদ বাড়াতে বেশি উপকরণের প্রয়োজন নেই। কল্লোলের কথায়, ‘আমরা মফস্সলের মানুষ। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। ফলে আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। আমাদের বাড়ি গঙ্গা থেকে দু’মিনিটের হাঁটা পথ। হাফ আঙুলের সাইজের ছোট ছোট চিংড়ি খুব সস্তায় পাওয়া যেত। মা সেটা অল্প ভেজে পাঁচফোড়ন, হলুদ, কালোজিরে দিয়ে যে ঝোলটা বানাতেন, সেটা দিয়েই আমরা দুই ভাই এক থালা ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম।’
ঘরোয়া উপকরণেই সুস্বাদু রান্নায় সুখ্যাতি রয়েছে, এমন এক রন্ধনশিল্পীর কথায়, ‘লাউ তো কম তেলে, সেদ্ধ করে রান্না করাই দস্তুর। তাতে স্বাদের ঘাটতি হতে পারে। কিন্তু শুকনো কড়াইয়ে চিংড়ি ভেজে যদি সেই লাউয়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই বাজিমাত। পুষ্টিগুণ তো বাড়লই, স্বাদও একেবারে তুঙ্গে।’
যদিও রন্ধন কর্মীরা বারবার যৎসামান্য বরাদ্দ আর অভাবের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের একটি স্কুলের রন্ধন সহায়িকা সেলিমা বিবির কথায়, ‘মাথাপিছু বরাদ্দ প্রাথমিকে ৫.৪৭ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৮.১৪ টাকা। সেখানে তেল, নুন, মশলা কিনলে ভাত-ডিম-সব্জির টাকা থাকে না। স্বাদ আনতে গেলে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।’