দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বৈঠকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সিট শেয়ারিং সম্পূর্ণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তৃণমূল। কংগ্রেসকে এই রাজ্যে দু’টি আসন ছাড়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে। যদিও এআইসিসি জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বরের ডেডলাইন মানা সম্ভব নয়। আসন সমঝোতা সম্পূর্ণ করতে সময় লাগবে। এই পরিস্থিতিতে বুধবার কংগ্রেস হাইকম্যান্ড রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’র কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
কংগ্রেস হাইকম্যান্ড যেমন সিট শেয়ারিং নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি, তেমনই বাংলার উপর দিয়ে রাহুলের ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’ গেলে সেক্ষেত্রে তৃণমূলের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে জোড়াফুলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেনি। যদিও তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ লোকসভা নির্বাচনের মুখে বাংলার উপর দিয়ে রাহুলের কর্মসূচিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার দেগঙ্গায় তৃণমূলের কর্মিসভায় মমতা বলেন, ‘ইন্ডিয়া জোট সারা ভারতে থাকবে আর বাংলায় তৃণমূল লড়াই করবে। মনে রাখবেন, বাংলায় তৃণমূলই বিজেপিকে শিক্ষা দিতে পারে। সারা ভারতকে পথ দেখাতে পারে। অন্য কোনও পার্টি নয়।’
মমতার এই মন্তব্য শুনে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ব্যানারে জোড়াফুল লড়াই করতে চায় না—এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। যদিও কংগ্রেস হাইকম্যান্ড যেহেতু বাংলায় তৃণমূলের হাত ধরার বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি, তাই আগ বাড়িয়ে বাংলার প্রথম সারির কংগ্রেস নেতারাও এ দিন মমতার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে জোট হবে কি না, তা যেমন এখনও পরিষ্কার নয়, তেমনই সার্বিকভাবে গোটা দেশের প্রেক্ষাপটে ‘ইন্ডিয়া’র মুখ কে হবেন, তা নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এদিন নতুন করে জলঘোলা হয়েছে বহুজন সমাজবাদী পার্টির ঘোষণায়। তাদের বক্তব্য, যদি মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তা হলে বিএসপি ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগ দিতে পারে।
বিএসপি সাংসদ মালুক নাগর এ দিন বলেছেন, ‘মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।’ অথচ বসপা ‘ইন্ডিয়া’ ও এনডিএ—দুই শিবির থেকেই সমদূরত্ব নিয়ে চলার কথাই এতদিন বলে আসছিল। ‘ইন্ডিয়া’র মিটিংয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বিরোধী জোটের মুখ হিসাবে মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁকে সমর্থন জানান অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও অখিলেশ যাদব। আবার জেডিইউয়ের নীতীশ কুমার এই প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বলে সূত্রের দাবি।
আর এক জোট শরিক এনসিপির প্রধান শরদ পাওয়ার আবার দু’দিন আগেই বলেছিলেন, বিরোধী জোটের মুখ নিয়ে এখনই ভাবার দরকার নেই। ১৯৭৭ সালে কোনও মুখ ঠিক না-করেই ভোটে লড়া হয়েছিল। প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছিল শিবসেনার (উদ্ধব) সঞ্জয় রাউতের গলায়। ফলে বাংলার পাশাপাশি দেশেও ‘ইন্ডিয়া’র সমীকরণ শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে অস্বচ্ছতা রয়েই গিয়েছে। এদিন নাগপুরে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভায় রাহুল গান্ধী ও খাড়গে ঘোষণা করেছেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোট ক্ষমতায় এলে কংগ্রেসের ন্যায় প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হবে।
কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’র শরিক দলগুলির মধ্যে আসন সমঝোতা সম্পূর্ণ করার বিষয়ে তাঁরা এদিনও কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের সম্ভাবনা তা হলে কতটা রয়েছে? এই প্রশ্নে এদিন কুণাল বলেন, ‘বাংলায় তৃণমূল একাই যথেষ্ট, একাই একশো। জোটের স্বার্থে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে দলনেত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আসন সমঝোতা নিয়ে শেষ কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন।’ রাহুলের ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’ নিয়ে কুণাল এদিনও তির্যক মন্তব্য করেছেন।
তাঁর কথায়, ‘এখানে বাম, বিজেপি, এসইউসিআই সভা করে। রাহুল গান্ধী যদি কর্মসূচি করতে চান, করবেন। কিন্তু তাঁর কর্মসূচির সময়ে প্রদেশ কংগ্রেস যেন তৃণমূলের কুৎসা করে বিজেপির হাত শক্ত না করে।’ দেগঙ্গার কর্মিসভায় আসন সমঝোতার প্রসঙ্গে মমতাও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের উদ্দেশে কোনও মন্তব্য করেননি। যদিও তাঁর কথায় প্রদেশ কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষের সুরই শোনা গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে তৃণমূলের মন্ত্রী-নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর প্রদেশ কংগ্রেস বিজেপি অথবা বামেদের ঢংয়েই মমতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিছুদিন আগে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও অধীর চৌধুরী তৃণমূল নেতৃত্বকে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। সেদিকে ইঙ্গিত করেই মমতা এ দিন বলেন, ‘সেই সুযোগে (বালুর গ্রেপ্তারি) সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি একসঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। রোজ মিছিল করছে। সবাইকে চোর-চোর বলছে।’
যদিও এর বেশি কংগ্রেসের কোনও সমালোচনা মমতা এদিন করেননি। বামেদের সঙ্গে বিজেপিকেই তিনি মূলত নিশানা করেছেন। শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপি ‘চোর-চোর’ স্লোগান তুলে হইচইয়ের চেষ্টা করায় পাল্টা মমতা এ দিন জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আওয়াজ তুলবেন, অলি গলি মে শোর হ্যায়, বিজেপি পার্টি চোর হ্যায়। চাই না, চাই না, বিজেপির দালালদের চাই না।’