সালটা ছিল ১৯৯৭। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব ছেড়ে প্রথমবার বিদেশ পাড়ি দিই। প্রথম গন্তব্য ছিল ইউএসএ, নিউ ইয়র্ক শহর। সেখানে কয়েক বছর কাটানোর পর পাড়ি দিলাম অস্ট্রেলিয়ায়। গত দু’দশক ধরে আমি ব্রিসবেন শহরের বাসিন্দা। আপাতত আমি অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী নাগরিক। যদিও মনেপ্রাণে নিজেকে বাঙালিই মনে করি।
জন্মেছি উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঁচরাপাড়ায়। শৈশব ওখানেই কেটেছে। এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই রেলের কোয়ার্টার, বাংলো, বৃটিশ আমলের সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, বেল ও হাইন্ডমার্শ ইনস্টিটিউট। সেখানে কত দেশি ও বিদেশি সিনেমা দেখতাম। বন্ধুদের সঙ্গে নাটক দেখতে যেতাম। আমাদের কোয়ার্টারের পাশেই ছিল ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনীর ঘাঁটি (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বৃটিশদের বানানো)। রেলের বড় কারখানা থাকার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের লোকজন আসতেন।
আর পাঁচটা মফস্সল শহরের থেকে আলাদা চরিত্র ছিল কাঁচরাপাড়ার। সেই কারণেই হয়তো শৈশব থেকে বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার জীবনবোধ তৈরি হয়েছিল। এখন আমি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজিতে অর্থনীতির (ফিন্যান্স) অধ্যাপক। পেনশন ও মিউচুয়াল ফান্ড, বিনিয়োগকারী সংস্থা এবং খুচরো বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব আমার গবেষণার বিষয়। অধ্যাপনার বাইরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ দিই।
অস্ট্রেলিয়া এবং ইউএসএ-র বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমার গবেষণাকে তাদের নীতি নির্ধারণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করেছে। কাজের জন্য আমাকে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটা আমার একটা প্যাশন। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার বহু দেশ ঘুরেছি। অবশ্য ইদানিং বেশির ভাগ ঘোরাফেরাই কাজের জন্য। এমআইটি’তে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়ায় গত কয়েক মাস বসে রয়েছি ইউএসএ-তে, বস্টন শহরের কাছে কেমব্রিজে।
কাজের সূত্রে কিছু পুরস্কার ও স্বীকৃতিও জুটেছে। গত দশ বছরে তিনবার ভাইস চ্যান্সেলর্স আ্যাওয়ার্ড, রিসার্চ ইমপ্যাক্ট আ্যাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ান ফিন্যান্সিয়াল রিভিউ ন্যাশনাল আ্যাওয়ার্ড ফর হায়ার এডুকেশন, ইউকে হায়ার এডুকেশন আ্যকাডেমি ফেলোশিপ, ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ইনস্টিটিউট অফ অস্ট্রেলেশিয়া ফেলোশিপও পেয়েছি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে কয়েক লক্ষ ডলার রিসার্চ গ্রান্ট পেয়েছি আমি।
পিছনে ফিরে তাকালে বার বার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রি-স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথমে ব্যান্ডেলের ডন বস্কো স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর গেলাম নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই কাঁচরাপাড়ার সাথে যোগাযোগটা কমতে থাকল। আমার পেশাগত জীবন কোনও দিন সরল রেখা ধরে চলেনি। নরেন্দ্রপুর থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তবে শেয়ার, বন্ডে বিনিয়োগের প্রতি ছাত্রাবস্থা থেকেই দুর্নিবার আকর্ষণ। তখন নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক।
মনমোহনী হাওয়ায় ভারতবর্ষের ঘুমন্ত অর্থনীতি জেগে উঠছে। সেই হাওয়ায় ভর করেই ফিজিক্স ছেড়ে ফিন্যান্সের জগতে পা রাখা। তারপর এক দশকের উপর দেশ-বিদেশে একাধিক ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। চাকরির জন্য পাটনা, চেন্নাই, আন্দামান— কত জায়গায় যেতে হয়েছে। এরপর আবার উচ্চশিক্ষার জগতে ফিরে আসি। প্রথমে এমবিএ, তারপর পিএইচডি। গবেষণার প্রতি ভালোবাসা বাড়ে।
বাংলা আমার মাতৃভূমি ঠিকই, তবে অস্ট্রেলিয়াও খুব পছন্দের দেশ। লোকজন নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালবাসে। বেশ শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং আমুদে প্রকৃতির। অস্ট্রেলিয়ায় ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থাকলেও পশ্চিমী দেশের তুলনায় এখানে বৈষম্য অনেক কম। আমি যেখানে থাকি, সেই ব্রিসবেন শহরটিও সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। বছরে প্রায় তিনশো দিন ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যায়। বাড়ি থেকে আধঘন্টা ড্রাইভ করলেই সুন্দর সমুদ্র সৈকত।
এখানকার শান্ত পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রথমে একটু অসুবিধে হতো। থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। রান্না, বাড়ির কাজকর্ম নিজেদেরই করতে হয়। পরিবার বলতে আমরা তিনজন। আমার স্ত্রী স্বাতী মনস্তত্ত্ববিদ। এখানে সবাই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন। তাই অনেক কর্পোরেট সংস্থা এবং এনজিও মনস্তত্ত্ববিদের পরামর্শ নিয়ে থাকে। আমার ছেলে সিদ্ধার্থ দশম শ্রেণীর ছাত্র। ও ভাল ক্রিকেট খেলে। স্কুল, ক্লাব বা ডিস্ট্রিক্টের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে।
ভেতো বাঙালি হলেও আমার বাহ্যিক আবেগ গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে কিছুটা কমই। দুর্গাপুজো কিংবা বইমেলার ভিড়, হই-হুল্লোড় বরাবরই এড়িয়ে চলি। তবে কাছের বন্ধুদের সঙ্গে টানা আড্ডা দেওয়ার স্বভাবটা মজ্জাগত। আর পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি, ই-পেপার হলেও বাংলা খবরের কাগজে একবার চোখ না বোলালে খাবার হজম হয় না। কলকাতায় বছরে একবার হলেও আসার চেষ্টা করি।
বহু পরিবর্তনের ফলে শহরটা এখন কিছুটা অচেনা লাগে। অনেক কিছু নিশ্চয়ই আগের থেকে ভালো হয়েছে। তবে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমে গেছে বলে মনে হয়। আমি কলকাতায় যখন থাকি, তখন বাংলায় কথা বলি। বাংলায় কথা বললে কোনও কোনও জায়গায় লোকে অবাক হয়ে তাকায়। এই ব্যাপারটা কষ্ট দেয়।
পরিচিতি:
নাম- অনুপ বসু
বয়স- ৫৩
বিদেশে পাড়ি- ১৯৯৭ সাল
কী করি- কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির অর্থনীতির অধ্যাপক
পরিবার- স্ত্রী এবং এক পুত্র
কোথায় থাকি- অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন
আসল বাড়ি- উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঁচরাপাড়া